ভোটের আগে রাজনীতির মাঠে সম্রাট-খালেদরা

ঢাকায় ক্যাসিনো কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ইসমাইল হোসেন সম্রাট।
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ক্যাসিনোকাণ্ডে বিতর্কিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতা পদ হারিয়েছিলেন, তারা এখনো দলীয় পদে ফিরতে পারেননি। তবে পদ-পদবি না পেলেও তাঁরা রাজনীতিতে ফিরতে শুরু করেছেন। এক সময় যেসব এলাকায় তাদের আধিপত্য ছিল, তা তাঁরা ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় আছেন এখন।

আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর সূত্র বলছে, ক্যাসিনোকাণ্ডে যে সব নেতার নাম এসেছিল, সে সময়ই তাদের প্রায় সবাইকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি বা সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তবে তারা প্রাথমিক সদস্যপদ হারাননি। ফলে তাদের রাজনীতি করতে সাংগঠনিক বাধা নেই—এই যুক্তি আছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কারও কারও। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদেরকে কাজে লাগানোর পক্ষেও তারা। তবে দলে ভিন্নমতও আছে।

দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বিতর্কিতদের বাদ দেওয়াতে দলের শক্তি কমেনি। ফলে তাদের পুনর্বাসনের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং বিতর্কিত লোকদের জন্য দলের বদনাম হবে।

তবে দলীয় পদ ফিরে না পেলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্যাসিনোকাণ্ডে বিতর্কিতদের মাঠে দেখা যাবে এবং এমনকি আগামী নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে তাদের অনেকেই পদ ফিরে পেতে পারেন– আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন।  তারা মনে করেন, তাদের দলের এমন অবস্থানের ক্ষেত্রে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোটের সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ। ওই ভোট নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক আছে।  অবশ্য সেই নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পর সেপ্টেম্বরে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। এ সময় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের এক ডজনের বেশি নেতার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা, অবৈধ প্রভাব বিস্তার ও টেন্ডারবাজিসহ নানা চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাই বেশি ছিলেন।

শুধু ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের নাম অপরাধী হিসেবে প্রকাশ্যে আসা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা অনেকটাই নজিরবিহীন। তাই সেই অভিযান বেশ আলোচিত হয়। অবশ্য অভিযান স্থায়ী হয় মাস দেড়েক। গ্রেপ্তার হন ১১ জনের মতো নেতা। বিদেশে পালিয়ে যান কেউ কেউ।

আওয়ামী লীগ নেতারা তখন অভিযানের কারণ সম্পর্কে দুটি বিষয়কে সামনে আনেন। প্রথমত, পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা থেকে দলের ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা হিসেবে সেই অভিযান পরিচালনা করা হয়। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ভেতর দুটি অংশের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এর বহিঃপ্রকাশ ছিল অভিযান।

অভিযানের পর পরই যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগসহ প্রায় সব সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ক্যাসিনো কাণ্ডে নামা আসা নেতারা বাদ পড়েন। এখন তাদের অনেকে আবার দলের পদ–পদবী না পেলেও রাজনীতিতে ফিরেছেন। এই বিষয়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনি বাধা না থাকলে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে কারও কর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আছে। তবে যুবলীগে পদ দেওয়া বা পাওয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।’

অবৈধভাবে ক্যাসিনো ক্লাব পরিচালনার অভিযোগে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নতুন করে যে কারণে আলোচনা

গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্তে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার কারণে দল থেকে বহিষ্কৃতদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এতে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাময়িক বহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ সারা দেশে শতাধিক নেতা ক্ষমা পান। এর মধ্যে ক্যাসিনো কাণ্ডে কারাগারে থাকা সহযোগী সংগঠনের নেতারা বেরিয়ে আসায় তারাও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হচ্ছেন কীনা সেই আলোচনা শুরু হয়।

আলোচিত মুখ যারা ছিলেন

যখন অভিযান হয়েছে, সে সময় যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছারের নাম আসে ক্যাসিনো কাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাদের।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ওমর ফারুক চৌধুরী এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। মোল্লা আবু কাওছারকে এখন আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে মাঝে-মধ্যে দেখা যায়। তবে তাদের দলীয় কোনো পদ নেই।

২০১৯ সালে অভিযান শুরু হয়েছিল ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে র‍্যাবের অভিযানের মাধ্যমে। সেখানে অবৈধভাবে ক্যাসিনো কারবার দেখতে পায় র‌্যাব। ওই ক্লাব পরিচালনা করতেন যুবলীগের সে সময়ের ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ওই দিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের তৎকালীন সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। পরে অভিযোগ উঠে, ঢাকায় ক্যাসিনো কারবারের পেছনে রয়েছেন ইসমাইল হোসেন। এরপর ইসমাইল হোসেনও গ্রেপ্তার হন। দুজনকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা আর পদে ফিরতে পারেননি। গত বছর মে মাসে ইসমাইল হোসেন জামিনে ছাড়া পান। সেপ্টেম্বরে ছাড়া পান খালেদ মাহমুদ।

ইসমাইল চৌধুরী ছাড়া পেয়েই ধানমন্ডিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিনি নেতা-কর্মী বেষ্টিত ছিলেন। এরপরই তাঁর রাজনীতিতে ফিরে আসার গুঞ্জন শুরু হয়। তবে তাঁকে আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ১১ ডিসেম্বর যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান এবং ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কর্মসূচিতে তাঁর অনুগতদের পাঠিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। খালেদ মাহমুদও ভেতরে-ভেতরে মতিঝিল-কমলাপুর এলাকায় আবারও প্রভাব তৈরিতে তৎপর আছেন। তাঁরা দুজনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে।

২০১৫ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালু করেছিলেন এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ। তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া মতিঝিল এলাকার আরও চারটি ক্লাবের ক্যাসিনোর ব্যবসাও তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০১৯ সালে অভিযানের সময় মমিনুল হক ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ নামে আলোচিত হন। তবে অভিযানের সময় তিনি দেশে ছিলেন না। তিনি অভিযানের আগেই সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন।  লম্বা সময় পর গত জানুয়ারি মাসে তিনি ফিরে আসেন। দেশে  ফিরেই তিনি পেয়েছেন হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদ।

ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনামুল হক ভূঁইয়া ওরফে এনু ও রুপন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয় ক্যাসিনো কারবারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে। তারা এখনো কারাগারে। তাদের বাসা থেকে তখন নগদ ৩২ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। দুই ভাইয়ের নামে ব্যাংকে পাওয়া যায় ১৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া এই দুই ভাইয়ের ফ্ল্যাট পাওয়া যায় ১২৮টি। এ ঘটনার পর তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, ওই দুজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক নেতা পরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেছেন। গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের অন্য যেসব নেতা তাদের সহযোগী ছিল, তারাও এখনো বহাল আছেন।

আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সূত্র জানিয়েছে, ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে পদ হারানো কারও নিকট ভবিষ্যতে নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা কম। তবে কেউ কেউ এখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগে জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে তাও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে না।