রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জে সাদিক আবদুল্লাহ

দলের ভেতর আলোচনা আছে, সমর্থন আদায়ে আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে বেগ পেতে হতে পারে।

আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ও সাদিক আবদুল্লাহ

বরিশাল সিটি নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে এবার শুরু থেকেই চরম নাটকীয়তা ছিল। এতে নতুন মাত্রা যোগ করে আওয়ামী লীগে চাচা-ভাতিজার মনোনয়নযুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হন চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত।

মনোনয়নবঞ্চিত হন ভাতিজা বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। রাজনীতির মাঠে নবীন খায়ের আবদুল্লাহর সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ ভোটে জয়ী হওয়া। আর সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে চ্যালেঞ্জ রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা।

বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের পুরোটাই সাদিক আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। আর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাঁর বাবা বর্ষীয়ান নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। ফলে জেলা আওয়ামী লীগও সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে। এমন পরিস্থিতিতে দলের সমর্থন আদায়ে খায়ের আবদুল্লাহকে বেগ পেতে হতে পারে।

‘খায়ের আবদুল্লাহ বরিশালে আসবেন, সেটা আমাদের বলা হয়নি। আমরা লোকমুখে শুনেছি।’
এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসাইন, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান

খায়ের আবদুল্লাহকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের ভেতরে। যদিও সাদিক আবদুল্লাহ গত মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়ালি এক সভায় যোগ দিয়ে নগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁর চাচাকে জয়ী করার জন্য। গতকাল বুধবার সকালে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ঢাকায় তাঁর বড় ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দোয়া চেয়েছেন।

নাম গোপন রাখার শর্তে নগর আওয়ামী লীগের অন্তত তিন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু পদক্ষেপ উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাসের মাত্রা কমবে এটা ঠিক, তবে সেটা পুরোপুরি ম্লান হবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ২০১৩ সালে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেনের (হিরন) পরাজয়ের দৃষ্টান্ত সামনে আনেন।

আবুল খায়ের আবদুল্লাহ আজ বৃহস্পতিবার বরিশালে ফেরার ঘোষণা দিলেও নগর আওয়ামী লীগ তাঁকে বরণ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আবুল খায়েরের সমর্থক, সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থকেরা তাঁকে বরণ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি রেখেছে।

নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসাইন এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘খায়ের আবদুল্লাহ বরিশালে আসবেন, সেটা আমাদের বলা হয়নি। আমরা লোকমুখে শুনেছি।’ দলে কোনো ক্ষোভ-দ্বন্দ্ব আছে কি না, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা তো মঙ্গলবার সভা করে প্রকাশ্যে বলে দিয়েছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।’

‘এ ধারণার সঙ্গে প্রার্থী ঘোষণা না করার কোনো যোগসূত্র নেই। মূলত আমরা কৌশলগত কারণে ঈদের পরে এখানে প্রার্থী ঘোষণা করব। আমরা অধিকতর পর্যালোচনার জন্যই এটা করেছি।’
অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য

নগরের নির্বাচন ও রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন, এমন অন্তত চার ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ মনোনয়ন পাওয়ায় বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থকেরা হতাশ। তার ওপরে এবার বিএনপি নির্বাচনী মাঠে না থাকায় ভোটারদের একটা বড় অংশের আনুকূল্য পাবেন বলে দলটির নেতাদের ধারণা।

এদিকে আওয়ামী লীগে অবিশ্বাসের সুযোগ নিতে চায় চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন। এসব সমীকরণ মেলাতেই দলটি চারটি সিটিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করলেও বরিশালে কালক্ষেপণ করছে। গত মঙ্গলবার দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করার কথা থাকলেও দুপুরের দিকে তা আকস্মিক স্থগিত করা হয়। প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে দলটির এমন নাটকীয়তা, সময়ক্ষেপণের ঘটনা নানা আলোচনার জন্ম দিচ্ছে।

মেয়র প্রার্থী হিসেবে দুজনকে বিবেচনা করছে ইসলামী আন্দোলনের নীতিনির্ধারণী মহল। এঁরা হলেন কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম এবং জেলা সভাপতি মুফতি সৈয়দ এছহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়ের। তাঁরা দুজনই বর্তমান পীরের আপন ভাই। তাঁদের মধ্যে আবুল খায়ের চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান।

বরিশালের রাজনীতিতে এরই মধ্যে নিজেদের ভোটব্যাংক তৈরি করতে পেরেছেন বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। তা ছাড়া এবার এখানে বিএনপি নির্বাচনী মাঠে না থাকায় দলটির সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। বরিশালে ইসলামী আন্দোলনের নিজস্ব ভোটব্যাংক থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে। ওই বছর বরিশাল-৫ (সিটি করপোরেশন-সদর) আসনে ২৭ হাজারের বেশি ভোট পায় দলটি। তখন দলটির প্রার্থী ছিলেন মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম।

আবুল খায়ের আবদুল্লাহ জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী। দল তাঁর পক্ষে কাজ করবে—এটাই স্বাভাবিক। আবুল খায়ের আবদুল্লাহ মনোনয়ন পাওয়ার পর বরিশালে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি এসেছে।
মীর আমিন উদ্দীন, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা, এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই ইসলামপন্থী দলটি বরিশাল নগরের নির্বাচনে এবার ভিন্নভাবে আবির্ভূত হতে চাইছে। এ জন্য ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অবিশ্বাসের বিষয়টি পরখ করে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে চায় হয়তো এই দল।’

এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন গতকাল বুধবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধারণার সঙ্গে প্রার্থী ঘোষণা না করার কোনো যোগসূত্র নেই। মূলত আমরা কৌশলগত কারণে ঈদের পরে এখানে প্রার্থী ঘোষণা করব। আমরা অধিকতর পর্যালোচনার জন্যই এটা করেছি।’

বরিশালে এবারের ভোটে অংশ নিচ্ছে না বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। গত নির্বাচনে এখানে মনীষা চক্রবর্তী প্রার্থী হয়ে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন। মাঠে আছেন জাপার প্রার্থী ইকবাল হোসেন ওরফে তাপস। এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও এখানে এবার প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল হাসান ওরফে রুপণ।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশাল জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, এবার নির্বাচনের শুরু থেকেই দলগুলোর মধ্যে নানা ধরনের নাটকীয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় চমক ছিল আবুল খায়ের আবদুল্লাহর দলীয় মনোনয়ন পাওয়া। তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জে নির্বাচনী যুদ্ধ। কারণ, দলের ভেতরের অবিশ্বাস দূর করে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে সেটা তাঁর জন্য নেতিবাচক হতে পারে। তবে এটা কঠিন কাজ।

এটা কোনো চ্যালেঞ্জ নয় বলে মনে করেন বরিশাল শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী। দল তাঁর পক্ষে কাজ করবে—এটাই স্বাভাবিক। আবুল খায়ের আবদুল্লাহ মনোনয়ন পাওয়ার পর বরিশালে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি এসেছে।

তাঁর পক্ষে যে জনমতের জোয়ার, তাতে ভোটাররাই তাঁর কর্মী হিসেবে কাজ করবেন। তিনি বলেন, বরিশালে প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এখন আর দলে পদ-পদবি নেই। তাঁরা ছিটকে পড়েছেন। অথচ নির্বাচনী মাঠে তাঁরাই দলের পক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই পদবঞ্চিত, নিগৃহীত বিশাল অংশটি আবুল খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে মাঠে নেমে গেছে।