ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ মঙ্গলবার দুপুরে ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলন হয়
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ মঙ্গলবার দুপুরে ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলন হয়

মাওলানা সাদ আসতে পারবেন না, টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখার ঘোষণা আলেমদের

বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের দাওয়াতি সংগঠন ‘তাবলিগ জামাত’ ও এই সংগঠন থেকে ‘বিচ্যুত মাওলানা সাদ কান্ধলভী’ সম্পর্কে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কওমি মাদ্রাসার শীর্ষস্থানীয় আলেমরা। তাঁরা বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমার স্থান টঙ্গী ময়দান এবং তাবলিগ জামাতের মারকাজ (প্রধান কেন্দ্র) কাকরাইল মসজিদ হাক্কানি আলেমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলনে’ হেফাজত ইসলামের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক খলিল আহমেদ কাসেমীসহ বিশিষ্ট আলেমরা সরকারের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।

বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতিতে সম্মেলনে ৯ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি এবং ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই পর্বে ছয় দিন বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের যাবতীয় কার্যক্রম হক্কানি আলেমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। সেখানে সাদপন্থীদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।

ঘোষণাপত্রে কওমি মাদ্রাসার ওপর হয়রানি ও হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে নিরীহ ছাত্র-জনতা ও মুসল্লিদের ওপর নৃশংস গণহত্যার দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার কার্যকর করার দাবি জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, স্বঘোষিত আমির মাওলানা সাদ কোরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা, নবী-রাসুল ও সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা-বিশ্বাসবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে বাধা দিয়েছে। বর্তমান সরকারের কাছে মহাসম্মেলন থেকে জোর দাবি জানানো হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না।

সম্মেলনে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সভাপতিত্ব করেন। তাঁর লিখিত বক্তব্য পড়েন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান মুরব্বি মাওলানা সাদ বিভিন্ন সময় কোরআন-হাদিস, ইসলাম, নবী-রাসুল, নবুওয়াত, সাহাবায়ে কেরাম এবং শরিয়তেরে মাসআলা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তাঁর বক্তব্যগুলো কোরআন-সুন্নাহবিরোধী, যা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর এসব আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিশ্ব আলেমদের কাছে তিনি চরম বিতর্কিত হয়েছেন। আলেমরা দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে সংশোধন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক খলিল আহমাদ কাসেমী। তিনি সাদ অনুসারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আপনারা কাকে অনুসরণ করছেন। যিনি নবী-রাসুল সম্পর্কে কটূক্তি করতে পারেন, তাঁর কাজ কখনোই ভালো হতে পারে না। তাঁকে অনুসরণ করলে আপনাদের দ্বীন এবং দুনিয়া দুটোই ধ্বংস হবে।’ তিনি বলেন, এখন থেকে টঙ্গী ইজতেমা ওলামায়ে কেরামদের হাতে থাকবে, কাকরাইল মসজিদ ওলামায়ে কেরামদের তত্ত্বাবধানে থাকবে।

হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে, তাবলিগের ব্যাপারে আলেমদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’

নুরুল ইসলাম ওলিপুরী বলেন, ১৮৬৬ সালে ভারতে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাবলিগ জামাত দেওবন্দ মাদ্রাসার এক বিশেষ অবদান। মাওলানা ইলিয়াছ কান্ধলভী (রহ) তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠা করেন। তাবলিগের এই অবদানকে বানচাল করার জন্য ইহুদি-খ্রিষ্টানদের পক্ষ থেকে মাওলানা সাদকে নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁকে সারা বিশ্বের মূলধারার আলেমরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। তাঁরা তাবলিগ জামাতের নামে মূলত তাবলিগের বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি গ্রুপ।

মাওলানা সাদকে নিয়ে বিভক্তি

তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে এর অনুসারীদের মধ্যে চরম বিভক্তি দেখা দেয়। এক পক্ষে বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়েরুল হক, অন্য পক্ষে মাওলানা সাদ পক্ষ। দুই পক্ষ টঙ্গীর ইজতেমা মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে ২০১৮ সাল থেকে দুই পক্ষ আলাদা ইজতেমার আয়োজন শুরু করেন। তার উল্লেখ করে মাওলানা শাহরিয়ার মাহমুদ বলেন, বিগত সরকারের সময় ইজতেমার একটি ধারা চালু করেছে। এত দিন আমরা মানতে বাধ্য হয়েছি। কাকরাইল মসজিদ আর টঙ্গীর মাঠ ভাগাভাগি করে দেবেন, আলেমসমাজ এবার আর তা মানবে না। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘তাবলিগের সমস্যাটা কোথায় আপনারা বোঝার চেষ্টা করুন। তাহলে সমাধান করা সম্ভব। এই সম্মেলনকে উপেক্ষা করবেন না।’

মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি সাদপন্থীদের ‘সাদিয়ানি’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কাদিয়ানিরা ব্রিটিশের দালাল, আর সাদিয়ানিরা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র”–এর দালাল। এই সাদিয়ানিদের কথায় অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাকে বিভ্রান্ত হতে শুনেছি। ১৬ বছর নির্যাতিত হয়েছি, কারাভোগ করেছি। অন্তর্বর্তী সরকারকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিন। এই সিদ্ধান্ত সরকার মানতে বাধ্য।’

‘ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলনে’ যোগ দিতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক আলেম–ওলামা জড়ো হন

মাওলানা রশিদুর রহমান বলেন, ‘তাবলিগ হচ্ছে ঐক্যের প্রতীক। যারা ঐক্য ভঙ্গ করেছে, তাদের বলব, আপনাদের জন্য দরজা খোলা আছে। আমরা দ্বীনের দাওয়াতের বিষয়ে বিভক্তি চাই না, ঐক্য চাই।’

সম্মেলনে বিশিষ্ট আলেমদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন আল্লামা আবদুল হামিদ, আবদুল রহমান হাফেজ্জী, নুরুল ইসলাম আদিব, ওবায়দুল্লাহ ফারুক, শাইখ জিয়াউদ্দিন, আবদুল কুদ্দুস, আরশাদ রহমানি, সালাহউদ্দীন নানপুরী, মুস্তাক আহমদ, মুফতি জসীম উদ্দিন, মুফতি কেফায়েত উল্লাহ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আনোয়ারুল করীম, জাফর আহমাদ, জুনায়েদ আল হাবিব, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, মুনির হোসাইন কাসেমী, আবদুল আউয়াল, মুহিউদ্দিন রাব্বানী, মামুনুল হক, নাজমুল হাসান কাসেমী, খালেদ সাইফুল্লাহ সা’দী, ইসমাইল নূরপুরী, আবদুল হক আজাদ, ফজলুল করিম কাসেমী প্রমুখ।

সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা ৬৫ জন আলেম বক্তব্য দেন। সকাল নয়টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন শুরু হলেও কার্যত সাতটা থেকে আলেমরা বক্তব্য দেন। এর আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজার হাজার মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা জড়ো হন। একপর্যায়ে উদ্যানে জায়গা না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা, শাহবাগ মোড় থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত সড়ক, শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কে ছড়িয়ে পড়েন। বেলা সোয়া একটায় মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়।