ব্যবসায়ী, তারকারাও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসার সুযোগ পাবেন মাত্র মাস চারেক। এত কম সময়ের জন্য হলেও ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, দলের নেতা ও চিত্রজগতের এক ডজনের বেশি ব্যক্তি দৌড়ঝাঁপ করছেন।

বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এখন একটি আসনের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের লম্বা তালিকা আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক দুজন সভাপতি, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, একাধিক চিত্রনায়ক-নায়িকার নাম আলোচনায় এসেছে। এখন পর্যন্ত যাঁদের নাম আলোচনায় এসেছে, তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি জসিম উদ্দিন, সাবেক সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শাম্‌স পরশ, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দুই সহসভাপতি ওয়াকিল উদ্দিন ও কাদের খান।

যে কেউ দলের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখাতে পারে। তবে মনোনয়ন দেওয়ার সময় নানা দিক পর্যালোচনা করা হয়। ফলে কে প্রার্থী হবেন, কে মনোনয়ন পাবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলার মতো সময় আসেনি।
কাজী জাফর উল্যাহ, সদস্য, মনোনয়ন বোর্ড, আওয়ামী লীগ

এর বাইরে ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিএনএফের আবুল কালাম আজাদও আগ্রহী। কেউ কেউ সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবালের কথাও বলছেন। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও চিত্রনায়ক ফেরদৌসকে নিয়েও আলোচনা আছে। এ ছাড়া কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারেরা চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত পেলে নিজেদের আগ্রহের কথা প্রকাশ করবেন—এমনটাই জানা গেছে।

চিত্রনায়ক আকবর হোসেন খান পাঠান (ফারুক) মারা যাওয়ার পর ঢাকা-১৭ আসন শূন্য হয়েছে। এখনো তফসিল ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে শূন্য আসনে আগামী জুলাইয়ে ভোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-১৭ আসনের ভোট বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয় আসনের উপনির্বাচনের মতো হবে না—এটা নিশ্চিত। গাজীপুর সিটি করপোরেশনে যেভাবে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে, সে রকমই হবে। সুতরাং যে কেউ চাইলে মনোনয়ন পেয়ে যাবেন, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। বিএনপি ভোটে অংশ না নিলেও কোনো একজন মোটামুটি পরিচিত স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে গেলে সরকারবিরোধী নেতিবাচক ভোট তাঁর বাক্সে চলে যাবে। নানামুখী চাপ (প্রেশার গ্রুপ) হয়তো থাকবে। কিন্তু ভালো প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে হবে।

কার কী সমীকরণ

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী জাফর উল্যাহর মূল আসন ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন)। সেখান থেকে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে এবং ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রী সংসদ সদস্য হন। কিন্তু সর্বশেষ দুবার ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হন মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী)। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনের ছেলে। ফরিদপুরে ঝামেলা এড়াতে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ জাফর উল্যাহকে ঢাকা-১৭ আসনে বিবেচনা করছেন। তবে তিনি নিজে এই বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি।

জানতে চাইলে কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রার্থীর হওয়া কিংবা দল থেকে মনোনয়ন দেওয়ার আলোচনা সম্পর্কে কিছু বলার নেই।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে তাঁর ভাই মোরশেদ আলম নোয়াখালী-২ আসনের সংসদ সদস্য। ফলে একই পরিবারে আরেকজনকে ঢাকায় মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা কতটা, সেই আলোচনা আছে দলে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক দুজন সভাপতি, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, একাধিক চিত্রনায়ক-নায়িকার নাম আলোচনায় এসেছে।

ফজলে ফাহিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ছেলে। তিনি এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন। পারিবারিক গণ্ডিতে তাঁর আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। তাঁর চাচাতো ভাই এবং শেখ মনির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশকে প্রার্থী করার বিষয়ে কিছু পোস্টারও চোখে পড়ে বনানী-গুলশান এলাকায়। যুবলীগের এই নেতার সম্ভাবনা নিয়ে দলের ভেতর আলোচনা আছে। তবে এখানেও একই পরিবারের দুজনের একজনকে বেছে নেওয়া কঠিন। ফলে এ দুজনের পাওয়া না–পাওয়ার সম্ভাবনা সমান সমান বলেই মনে করেন দলের নেতারা। চিত্রজগৎ ও ক্রিকেটারের বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন না দলীয় নেতারা।

 এই আসনে মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দুই সহসভাপতি ওয়াকিল উদ্দিন ও কাদের খান। তাঁরা দুজনই গুলশান থানা আওয়ামী লীগ ও মহানগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁদের বিমুখ হতে হয়।

এবার দুজনই মনোনয়ন পেতে আশাবাদী। ওয়াকিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পরপর তিনবার চেষ্টা করেও পাননি। এরপরও রাজপথে ও সামাজিক নানা দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এবার দল মূল্যায়ন করবে বলে তিনি মনে করেন। আর কাদের খান বলেন, স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে ভোটারদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা বেশি। তাই এবার তিনি আশা করছেন।

মূল লক্ষ্য আগামী নির্বাচন

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা-১৭ আসনে ভোট হলে কাকে দলীয় প্রার্থী করা হতে পারে, এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো ফোরামে এখনো আলোচনা হয়নি।

দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা কাউকে ভেবে রেখেছেন কি না, সেটাও জানা যায়নি। ফলে এখন পর্যন্ত যাঁদের নাম আসছে, তাঁদের সবাইকে আগ্রহী হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আগ্রহীদের কাছে দলীয় ফরম বিক্রি করা হবে। এর সংসদীয় বোর্ডের সভায় একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, স্বল্প সময়ের কথা বিবেচনা করে আগ্রহীরা দৌড়ঝাঁপ করছেন না; বরং আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিশ্চিত করাই তাঁদের লক্ষ্য। কারণ, উপনির্বাচনে যিনি মনোনয়ন পাবেন, পরের ভোটে তাঁকেই রেখে দেওয়া হবে—এমনটা ধরেই নেওয়া যায়। এ জন্যই আগ্রহ বেশি।

এই আসনটির গুরুত্ব আছে

ঢাকা-১৭ আসনটি গুলশান, বনানী, ভাষানটেক থানা ও সেনানিবাস এলাকা নিয়ে গঠিত। ২০০৮ সালে ঢাকা-১৭ আসন থেকে ভোট করার আগ্রহ প্রকাশ করেন সাবেক সামরিক শাসক ও জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। মহাজোটের স্বার্থে এরশাদকে আসনটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির আরেক সাবেক সেনা কর্মকর্তা হান্নান শাহকে হারিয়ে।

২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরশাদ পুনরায় এই আসন থেকে মনোনয়ন চান। তবে শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা না–থাকা নিয়ে নাটকের মধ্যে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। বিএনএফ নামে একটি অপরিচিত দলের প্রধান আবুল কালাম আজাদ নির্বাচিত হন। তবে আলোচনা আছে যে তাঁকে তখন সরকারের ভেতর থেকে দাঁড় করানো হয়েছিল। সর্বশেষ নির্বাচনে প্রয়াত চিত্রনায়ক ফারুক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হন।

দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, যে কেউ দলের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখাতে পারে। তবে মনোনয়ন দেওয়ার সময় নানা দিক পর্যালোচনা করা হয়। ফলে কে প্রার্থী হবেন, কে মনোনয়ন পাবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলার মতো সময় আসেনি।