তখনো বিরোধী দলে বিএনপি, ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সময়টা ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি। ওই সময় টানা সংসদ বর্জন করে আসছিল বিএনপি। তাদের সংসদে ফিরিয়ে আনতে যে কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, তা বেশ কাজে দিয়েছিল। তবে ওই কৌশল নিয়ে তখন রাজনীতিতে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এমনকি এখনো সেই বিতর্ক থামেনি।
প্রতিপক্ষের ভেতরে যেকোনোভাবেই হোক অবিশ্বাস-সন্দেহ তৈরি করো—রাজনীতিতে কৌশল হিসেবে এটি বেশ কার্যকর ও স্বীকৃত। আওয়ামী লীগ ১৯৯৮ সালে এই কৌশল প্রয়োগ করে ‘ফল’ পেয়েছিল। সপ্তম সংসদের বিরোধী দল বিএনপি ১৯০ দিন পর সংসদে ফিরেছিল আওয়ামী লীগের ওই কৌশলের কারণে। যদিও সংসদে ফেরার আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির ‘মুখ রক্ষার’ সংলাপ-সমঝোতা হয়েছিল; কিন্তু মূলে ছিল ওই কৌশল।
১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের নেওয়া সেই কৌশলের ‘ছায়া’ এখন আবার দেখা যাচ্ছে। দুই যুগ আগে এক ফেব্রুয়ারি মাসে যা দেখা গিয়েছিল, সেটিই ভিন্নভাবে মঞ্চস্থ হতে চলেছে এই ফেব্রুয়ারিতে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে।
এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে (সরাইল ও আশুগঞ্জ) স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি থেকে পদত্যাগী ও বহিষ্কৃত নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া, যিনি বিদায়ী বছরের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আসনেরই বিএনপি–দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। এরপর দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে সংসদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে সংসদে থাকা বিএনপির বাকি ছয় সদস্যও (একজন সংরক্ষিত নারী আসনের) পদত্যাগ করেছেন।
তবে উকিল আবদুস সাত্তার বিএনপিকে ‘বিদায়’ দিয়ে আবার উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের ‘মন জয় করে’ নিয়েছেন। ভোটে তাঁকে জিতিয়ে আনতে নিজ দলের তিন বিদ্রোহী প্রার্থীকে ‘কোরবানি’ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমনকি সংসদে এখন বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টির নেতারাও উকিলের পক্ষে মাঠে নেমেছেন।
দৈব কিছু না ঘটলে উকিলের ভাগ্য শুধু ভোটে জয়ী হয়ে আবার সংসদ সদস্য হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। সামনে হয়তো আরও বড় কিছু তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছে। এর কারণ যে কৌশলে ১৯৯৮ সালে বিএনপিকে সংসদে এনেছিল আওয়ামী লীগ, এবারের কৌশলে তার চেয়েও বড় কিছু অর্জনের বিষয় রয়েছে—এমন আলোচনা আছে রাজনীতিতে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। ওই সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশনের প্রথম দিনে (১৯৯৭ সালের ৩০ আগস্ট) সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে বিএনপি। এটি অব্যাহত ছিল ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত। টানা ১৯০ দিন পর বিএনপি সংসদে ফিরেছিল ওই বছরের ৮ মার্চ। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের রাজনীতিতে পরপর দুটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী লীগের কৌশল থেকেই ওই দুই ঘটনা ঘটেছিল। সপ্তম সংসদে বিএনপি যখন টানা সংসদ বর্জন করে আসছিল, তখন দলটির দুজন সংসদ সদস্যকে অনেকটা আকস্মিকভাবে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই সরকার জাতীয় ঐকমত্যের সরকার হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় প্রথমে যোগ দেন বিএনপির সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন।
তাঁকে শিল্প উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর এক সপ্তাহ পর বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলাউদ্দিনও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তাঁকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুটি ঘটনাই তখন দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। বিএনপি সংসদ বর্জন করা অবস্থাতেই ওই দুজন সংসদে যোগ দেন ১৯৯৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।
হাসিবুর রহমানের সংসদীয় আসন ছিল সিরাজগঞ্জ-৭। তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ না করেই আওয়ামী লীগ সরকারে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সময় তাঁকে ‘তৃতীয় শ্রেণির’ সংসদ সদস্য বলেছিলেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া।
জাতীয় রাজনীতিতে হাসিবুর তখন অপরিচিত হলেও মোহাম্মদ আলাউদ্দিন সে রকম ছিলেন না। তিনি রাজশাহী-৫ (তখনকার সংসদীয় আসন) আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হলেও প্রায় সারা জীবনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে ভোটের আগে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মাত্র দেড় বছরের মাথায় আওয়ামী লীগ সরকারে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মূলত, এ দুই ঘটনা তখন বিএনপির ভেতরে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি করেছিল। আওয়ামী লীগের এ কৌশলের কারণেই বিএনপি দ্রুত মত পাল্টে তখন সংসদে ফিরে এসেছিল।
যদিও বিএনপিকে সংসদে ফেরাতে স্পিকারের মধ্যস্থতায় তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে লিখিত চুক্তি হয়েছিল; কিন্তু ওই চুক্তিতে যেতে বিএনপিকে বাধ্য করেছিল মূলত আওয়ামী লীগের সেই কৌশল (বিএনপির দুজনকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া)।
দুই যুগ আগে বিএনপিকে সংসদে ফেরাতে আওয়ামী লীগের সেই সরকার সমঝোতা-সংলাপের পথে হাঁটলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপে যেতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। একই অবস্থান বিএনপিরও। দুই পক্ষই এখন রাজপথেই সবকিছুর ‘মীমাংসা’ চায়।
দুই যুগ আগে ‘কৌশলে হারলেও’ বিএনপি যেসব দাবিতে সংসদ বর্জন করেছিল, তা এখনকার রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিক। তখন বিএনপির তিনটি দাবির প্রথমটি ছিল দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে যেতে (ওই সময় জিয়া উদ্যান, এখন চন্দ্রিমা উদ্যান) বেইলি ব্রিজ পুনঃস্থাপন; দ্বিতীয়টি ছিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও প্রেসক্লাবের সামনে জনসভার অনুমতি দেওয়া। তৃতীয় দাবি ছিল বিএনপির সংসদ সদস্য ও নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার।
এ তিন দাবির মধ্যে প্রথমটি অবশ্য বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে নিজেই ভালোভাবে পূরণ করেছে। আর দুটি দাবি এখনো বিএনপির জন্য প্রাসঙ্গিক। এর মধ্যে গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েও শেষ পর্যন্ত পায়নি। এ নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা-সংঘাত গত বছর দেশের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল। আর দেশের রাজনীতিতে যখন যে দল বিরোধী দলে থাকে, তাদের ভাগ্যে গ্রেপ্তার-মামলা নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। যে দলই ক্ষমতায় থাকবে, তারা বিরোধীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করবে—এটি এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম বাস্তবতা হয়ে গেছে।
১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সংসদে যোগ দেওয়া এবং সরকারের মন্ত্রী হওয়া নিয়ে দুজনের সংসদ সদস্যের (হাসিবুর রহমান ও মোহাম্মদ আলাউদ্দিন) পদ বাতিল চেয়ে বিএনপি স্পিকারের কাছে আবেদন করেছিল। কিন্তু স্পিকার সে আবেদন আমলে নেননি। পরে বিএনপি আদালতে যায়। আদালত ওই দুজনের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ছেড়ে দেন নির্বাচন কমিশনের ওপর।
নির্বাচন কমিশন দুজনের সংসদ সদস্য পদ শূন্য ঘোষণা করে। পরে সংসদের ওই দুই আসনে উপনির্বাচন হলে হাসিবুর রহমান ও মোহাম্মদ আলাউদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। কিন্তু আলাউদ্দিন জয়ী হলেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী চয়ন ইসলামের কাছে হেরে যান হাসিবুর। কিন্তু তাঁকে সরকারে উপমন্ত্রী হিসেবে রেখে দেয় আওয়ামী লীগ।
পরে অবশ্য ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সিরাজগঞ্জ-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন হাসিবুর রহমান। তিনি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে করোনায় মারা গেছেন। আর মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ২০০০ সালে মারা যান প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই।
অতীত অভিজ্ঞতার কারণে বিএনপির কোনো সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী করার ঝুঁকি কী, সেটি আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই জানে। মন্ত্রিসভায় নিলেও সংসদ সদস্য পদ টেকানো যায় না। তাই এবার পুরোনো পথে না হেঁটে আওয়ামী লীগ কৌশল বদল করেছে—এমন আলোচনা আছে রাজনীতিতে। তা ছাড়া ওই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতাও এখন আর নেই।
সামনে জাতীয় নির্বাচন, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলে ভোটে যাবে না—এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে দলটির প্রভাবশালী কিছু নেতাকে ভোটে আনা গেলে বিএনপি চাপে পড়বে, পাশাপাশি দলের ভেতরেও অবিশ্বাস-সন্দেহ বাড়বে, যা দিন শেষে সুবিধা দেবে আওয়ামী লীগকে। আগামী ফেব্রুয়ারির উপনির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তারকে সমর্থন দেওয়া যার ‘টেস্ট কেস’ বলে মনে করছেন অনেকে।
বিএনপিকে রাজপথে চাপে রাখার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতেও ঝামেলায় ফেলতে আওয়ামী লীগের এ কৌশল সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন।
২৩ জানুয়ারি আশুগঞ্জে উকিল আবদুস সাত্তারের সমর্থনে আয়োজিত কর্মিসভায় আহমেদ হোসেন বলেছেন, ‘বিএনপির রিজাইনড প্রার্থীকে আমরা সমর্থন কেন দিলাম? এর একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে।’
এটুকু ইঙ্গিত দিয়েই বক্তব্য শেষ করেননি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন; কেন উকিলকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ, সে বিষয়ে ওই কর্মিসভায় তিনি বলেছেন, ‘আপনি বোঝেন না? কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি বোঝেন আপনি? বোঝেন? আমাদের এখানে কথা আছে, যার আক্কেল আছে, সে ইশারায় বোঝে। আর যে বেক্কল, তারে ধাক্কা দিয়া বুঝাইতে হয়। নিজের সম্মান, দক্ষতা, নেতৃত্বের যোগ্যতা ও আগামী দিনের যদি স্বপ্ন থাকে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এটি সেমিফাইনাল। এই সেমিফাইনালে জিততে হবে।’
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো