শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতা প্রায় গুছিয়ে এনেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের সাতটি দেওয়া হয়েছে। আর বাড়তি আসন দেওয়ার চিন্তা নেই আওয়ামী লীগের। এর বাইরে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত সুপ্রিম পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম এবং বিএনপির জোট ছেড়ে আসা কল্যাণ পার্টির কিছু নেতাকে জয়ী করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে এসব নেতার আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানোর চিন্তা নেই।
আওয়ামী লীগ, জোট ও মিত্রদের সূত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, আসন ভাগাভাগিতে পাওয়া সাত আসনে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতারা এবারও নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে আগে বরিশাল–৩ আসনে ছাড় দেওয়ার কথা জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই আসনে নির্বাচন করার ব্যাপারে অস্বস্তিতে ছিলেন মেনন। পরে গতকাল তাঁকে বরিশাল ৩–এর বদলে বরিশাল–২ আসন দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বুঝে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকছে।
গত রাতে জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গেও ২৬টি আসনে সমঝোতা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের। আর অন্য মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি পুরোপুরি অনানুষ্ঠানিক রাখবে আওয়ামী লীগ। এসব মিত্রের কাকে কাকে জয়ী করা হবে, এটা তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ৩০০ আসনের মধ্যে শরিক ও মিত্রদের মোট ৪০টি আসনে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক ছাড় দেওয়া হতে পারে। জাপা ও ১৪ দলের বাইরে কল্যাণ পার্টির জেনারেল মুহাম্মদ ইবরাহিমকে কক্সবাজার থেকে জিতিয়ে আনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ফরিদপুরে বিএনএমের শাহ আবু জাফরকে জেতার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূল বিএনপির সমশের মবিন চৌধুরীকে সিলেটে এবং তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জে ভোট করছেন। তাঁদেরকে জেতানোর চূড়ান্ত আশ্বাস দেওয়া হয়নি। তবে তাঁদের জন্যও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
১৪–দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তিনটি করে আসন ভাগে পেয়েছে। জাতীয় পার্টির (জেপি) ভাগে একটি আসন। তবে এই শরিকেরা আসন পেলেও খুশি নয়। তারা বলছে, তাদের ভাগে পাওয়া আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র থাকতে পারবে না।
সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারার সঙ্গে এবার কোনো সমঝোতার কথা শোনা যায় না। দলটির মহাসচিব এম এ মান্নানের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। বি চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে ভোট করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ১৪ দল ও জাপার ভাগে পাওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়া হবে। তবে আওয়ামী লীগ তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি মানেনি। আর জাপা ভোট করবে লাঙ্গলে। সেখানে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী থাকবে না। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বুঝে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকছে।
এদিকে ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে কারও সঙ্গেই আসন সমঝোতার সম্ভাবনা নেই। এসব দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পক্ষে যারা যোগাযোগ করেছে, তারা আসন পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবেচনার জন্য অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়েছে।
জোটের শরিকদের সাতটি আসনে নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এটাই চূড়ান্ত নয়। আমরা জানি, আমরা আছি।নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী
১৪–দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তিনটি করে আসন ভাগে পেয়েছে। জাতীয় পার্টির (জেপি) ভাগে একটি আসন। তবে এই শরিকেরা আসন পেলেও খুশি নয়। তারা বলছে, তাদের ভাগে পাওয়া আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র থাকতে পারবে না।
শরিকেরা যে সাতটি আসন পেয়েছে, এর প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বরিশাল-৩ আসন গত রাতে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয়েছে। আর মেনন পেয়েছেন বরিশাল-২ আসন। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন তালুকদার ইউনূস।
এদিকে হাসানুল হক ইনু নিজের কুষ্টিয়া-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। তিনি যেকোনো মূল্যে স্বতন্ত্র সরাতে তৎপর। তিনি এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর সময় চেয়ে এখনো পাননি।
হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা তাঁদের অসন্তোষ জানিয়ে দিয়েছেন। আসনও বাড়াতে হবে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীও সরাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন।
তবে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, যে তিন দল আসন ভাগে পেয়েছে, তাদের মূল দুশ্চিন্তা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে। আসন বাড়ানোর দাবিটি তাদের রাজনৈতিক চাপ হতে পারে।
‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত সুপ্রিম পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম এবং বিএনপির জোট ছেড়ে আসা কল্যাণ পার্টির কিছু নেতাকে জয়ী করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর আসন নিয়ে গতকাল শুক্রবার দিনভর নানা আলোচনা, তৎপরতা চলেছে। তবে বিষয়টি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। গতকাল রাত পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তবে সূত্র বলছে, সুপ্রিম পার্টির সৈয়দ সাইফুদ্দিন মাইজভাণ্ডারীকে আসনটি দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আগ্রহ দেখিয়েছেন।
নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী গতকাল সকালে ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘জোটের শরিকদের সাতটি আসনে নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এটাই চূড়ান্ত নয়। আমরা জানি, আমরা আছি।’
১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু প্রথম আলোকে বলেন, শরিকদের যে সাতটি আসন দেওয়া হয়েছে, এর বাইরে বাড়তি আসনের কোনো আলোচনা নেই। তরীকত ফেডারেশনের আসনটির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত জানাবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী সরিয়ে দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এবার নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। এর প্রায় সবাই সরাসরি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন সমঝোতা চায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিবন্ধন পাওয়া তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম নিয়ে আগ্রহটা একটু বেশি। এর বাইরে আছে কল্যাণ পার্টি ও বিএনএফ।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম যেভাবে বিএনপি ভেঙে নির্বাচন জমিয়ে তুলবে বলে মনে করা হয়েছিল, তা পারেনি। এ জন্য জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতায় যেতে হয়েছে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখেছে আওয়ামী লীগ। ফলে এ দুটি দলকে আসন ছাড়ের বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয় আওয়ামী লীগ। তবে এই দলগুলো ভোটে এসেছে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করা ব্যক্তির আশ্বাসে। ফলে কোনো কোনো পরিচিত নেতাকে জিতিয়ে আনার একটা চেষ্টা থাকবে। তবে আনুষ্ঠানিক সমঝোতা করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরিয়ে দেওয়া হবে না।
কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদের প্রার্থিতা আপিলেও গতকাল বাতিল রয়েছে। ফলে এই আসনে কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের জন্য অনেকটা সহজ হলো। এই আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ইবরাহিমকে জয়ী করার ব্যাপারে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কাজ করবে।
ফরিদপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীও আছেন। এই আসনে বিএনপি ছেড়ে বিএনএমে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। সব প্রার্থী রেখেই শাহ জাফরের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়। আবু জাফরের কিছু কর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা এবং তাঁর কর্মীদের পুলিশ বিরক্ত করবে না, এমন আশ্বাস তিনি পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
শাহ আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছেন। নেতা-কর্মীদের বিরক্ত করা হবে না—এই নিশ্চয়তা চেয়েছেন। তাঁর চাওয়া পূরণ হচ্ছে বলেও তিনি জানান।