সিলেটে আজ নাগরিক সভা করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া না–হওয়ার প্রশ্নে আরিফুল হক চৌধুরী নিজের অবস্থান জানাবেন।
টানা দুবারের মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী শেষ পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না, সেটি এখন সিলেটে আলোচনার কেন্দ্রে। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, তাঁর প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
আজ বিকেলে সিলেট শহরে রেজিস্টারি মাঠে ‘ভোটার, সমর্থক ও কর্মীদের’ নিয়ে সমাবেশ ডেকেছেন আরিফুল হক। এই সমাবেশ থেকে নিজের প্রার্থিতার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে তিনি এর আগে ঘোষণা দিয়েছেন।
বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে না, তা আগেই জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা বিবেচনায় আরিফুল হক সিলেটে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন, সে আলোচনা শুরু থেকেই রয়েছে। তবে তিনি নিজেও বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। ফলে বিষয়টি নিয়ে সিলেটের মানুষের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। আরিফুল হকের ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, এই নির্বাচন নিয়ে তিনি নানামুখী চাপে আছেন। একদিকে দলীয় অবস্থান, অন্যদিকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা—সব মিলিয়ে নানা হিসাব–নিকাশ মেলাতে হচ্ছে তাঁকে।
আরিফুল হক ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রয়াত মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে হারিয়ে প্রথমবার মেয়র হন। ২০১৮ সালের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চারটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়লাভ করেন। একমাত্র সিলেটে বিএনপি থেকে আরিফুল হক মেয়র নির্বাচিত হন। যে কারণে এবারও সিলেটের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল বেশি।
ঢাকা ও সিলেটের রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি এখন আন্দোলনে রয়েছে। এ অবস্থায় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে আরিফুল হককে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা নিরুৎসাহিত করেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা মনে করছেন, এবার সিলেটে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে যেকোনো মূল্যে জেতাতে ক্ষমতাসীন দল সকল কৌশল প্রয়োগ করবে। এমতাবস্থায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে গিয়ে পরাজিত হলে তাঁকে দলীয় রাজনীতিতে মূল্য দিতে হবে।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানিয়েছে, সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও দলটির মনোনয়ন নিয়ে টানা দুই বারের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
২০ মে নাগরিক সভা করে সিটি নির্বাচনে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবেন, এটা আগেই জানিয়েছিলেন আরিফুল হক। গত মঙ্গলবার সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরীফের কাছে নাগরিক সভার বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। গতকাল শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে নগরের রেজিস্টারি মাঠে মঞ্চ নির্মাণের জন্য শ্রমিকেরা উপকরণ নিয়ে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সদস্যরা শ্রমিকদের জানান, নাগরিক সভা করতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। খবর পেয়ে সাড়ে চারটার দিকে সেখানে ছুটে যান মেয়র আরিফুল হক। পুলিশ তাঁকেও মাঠে ঢুকতে বাধা দেয়।
দলীয় সূত্র জানায়, মাঠের প্রধান ফটক বন্ধ করে রাখায় মেয়র আরিফুল হক ভেতরে ঢুকতে পারছিলেন না। এরপর তিনি ফটকের সামনে একটা চেয়ার পেতে অবস্থান নেন। সভা করার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত ফটকের সামনেই অবস্থান করবেন বলে ঘোষণা দেন। খবর পেয়ে তাঁর সমর্থকেরা নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে সেখানে জড়ো হন। এ অবস্থায় বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পুলিশ আগের সিদ্ধান্ত বদল করে সভা করার মৌখিক অনুমতি দেয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের স্থানীয় ১০ জন নেতাকে বাদ দিয়ে লন্ডনপ্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করার বিষয়টি স্থানীয় নেতাদের অনেকে মেনে নিতে পারেননি।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) সুদীপ দাস প্রথম আলোকে বলেন, নাগরিক সভা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে আরিফুল হককে প্রথমে সভা না করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। পরে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় তাঁকে সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়।
সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে ফটক খুলে দেওয়া হলে মঞ্চ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ সময় আরিফুল হক চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আজ শনিবার বেলা তিনটায় পূর্বনির্ধারিত সভা হবে। সেখানেই তিনি প্রার্থিতার বিষয়টি স্পষ্ট করবেন।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানিয়েছে, সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও দলটির মনোনয়ন নিয়ে টানা দুই বারের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। গত মাসের শুরুতে আরিফুল হক লন্ডনে যান। প্রায় দুই সপ্তাহে সেখানে তিনি অবস্থান করেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সবুজ সংকেতের জন্যই তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন বলে তাঁর অনুসারীরা মনে করেন। তবে তিনি প্রার্থী হলে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রশ্নের মুখে পড়বে—এমন বার্তা দিয়ে দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আরিফুলের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয় বলে দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দল–মতনির্বিশেষে নগরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁকে নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ দিচ্ছেন। অন্যদিকে যৌক্তিক কারণেই তাঁর দল বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তবে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আজ শনিবার ৪২টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের উপস্থিতিতে জনসভায় নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবেন তিনি।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের স্থানীয় ১০ জন নেতাকে বাদ দিয়ে লন্ডনপ্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করার বিষয়টি স্থানীয় নেতাদের অনেকে মেনে নিতে পারেননি। প্রবাসী হয়েও তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার পেছনে দলের প্রভাবশালী অংশের জোর সমর্থন রয়েছে বলে এলাকায় প্রচার আছে। সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, আরিফুল হক প্রার্থী হলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তাই আরিফুল ভোট থেকে সরে গেলে সেটা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য সুবিধাজনক হবে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বা সরকারের একটি অংশ চাইছিল, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে আরিফুল হক প্রার্থী থাকুক। আরিফুল হকের ঘনিষ্ঠ একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আরিফুল হক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের তৎপরতাও বিবেচনায় নিচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সিলেট সিটি নির্বাচনের ভোট হবে আগামী ২১ জুন। মনোনয়নপত্র দাখিল করার শেষ দিন ২৩ মে। মনোনয়নপত্র বাছাই ২৫ মে ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১ জুন। ২ জুন প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার-প্রচারণা শুরু করতে পারবেন।