পুলিশের অভিযান

৮ দিনে সারা দেশে গ্রেপ্তার প্রায় ৮ হাজার নেতা–কর্মী

২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, পুলিশ হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর থেকে দলটির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার চলছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ। ঢাকা, ২৯ অক্টোবর
ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে সংঘাতের পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত আট দিনে সারা দেশে দলটির অন্তত ৭ হাজার ৮৩৫ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতা রয়েছেন অন্তত সাতজন। সাবেক সংসদ সদস্যসহ জেলা ও মহানগর পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা রয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে পুলিশের ব্যাপক অভিযান শুরুর পর বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতার বেশির ভাগই আত্মগোপনে রয়েছেন।

সর্বশেষ গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ফেনীর পরশুরামের সাবেক পৌর মেয়র আবু তালেবকে আটক করা হয়েছে বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পুলিশ আটকের কথা স্বীকার করেনি।

বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে প্রিজন ভ্যানে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরের তিন জেলায় মোট ১১২ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে ঢাকার আদালত ও প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা গেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ৭০ জন এবং নারায়ণগঞ্জে ৩৯ জন, ফেনীতে ১ জন ও জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত আট দিনে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ২৩৯ নেতা-কর্মী। সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সংঘর্ষ, পুলিশ হত্যা, পুলিশের অস্ত্র লুট, হরতাল ও অবরোধে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা মামলায় বেশির ভাগ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বিএনপি ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস (বাঁয়ে) ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন আলাল

গুরুত্বপূর্ণ ৭ নেতা রিমান্ডে

বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরদিন ২৯ অক্টোবর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। পরে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, মজিবর রহমান সরোয়ার, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক ও সর্বশেষ এমরান সালেহ (প্রিন্স)।

২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষে পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও জহির উদ্দিনের (স্বপন) ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পর আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। গতকাল শুক্রবারের ছবি।

তাঁদের মধ্যে মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মোয়াজ্জেম হোসেন, জহির উদ্দিন স্বপন ও আমিনুল ইসলাম রিমান্ডে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। আদালত তাঁদের পাঁচ থেকে ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আমীর খসরু, মোয়াজ্জেম হোসেন, জহির উদ্দিন স্বপন ও আমিনুলকে পুলিশ হত্যা মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা হত্যায় জড়িত থাকার কথা এখনো স্বীকার করেননি। আর মির্জা আব্বাসকে শাহজাহানপুরে পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অস্ত্র ছিনতাইয়ের মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ হত্যা মামলায় পরে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে। প্রয়োজন হলে ওই মামলাতেও তাঁকে রিমান্ডের আবেদন করা হবে।

এর আগে গত বুধবার রিমান্ড শুনানিতে মির্জা আব্বাস আদালতে বলেছেন, বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। তাঁদের মতো নেতাদের শেষ করে দেওয়া হবে।

ঢাকার বাইরে গ্রেপ্তার ৫,৫৯৭

প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যমতে, গত আট দিনে (২৮ অক্টোবর-৪ নভেম্বর) ঢাকা মহানগরের বাইরে দেশের অন্যান্য জেলায় বিএনপির ৫ হাজার ৫৯৭ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে যশোরে ৪৫০, চট্টগ্রামে ৩১০, নারায়ণগঞ্জে ২৬৭, সিরাজগঞ্জে ২৩৮, ঝিনাইদহে ২২০ ও নওগাঁয় ২০৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। নোয়াখালীতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭৫ জন। প্রায় দেড় শ করে গ্রেপ্তার আছেন দিনাজপুর, খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, পাবনা, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদীতে। পিরোজপুর, পটুয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় গ্রেপ্তার হয়েছেন জেলাপ্রতি ১০০ জন বা তার বেশি। ৭০ জনের বেশি গ্রেপ্তার আছেন নাটোর, জয়পুরহাট, শেরপুর ও জামালপুরে। বাকি জেলাগুলোতে ২ থেকে ৫০ জন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন। রাজধানীর বাইরে ঢাকা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ৬৫ জন গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে।

জেলা পর্যায়ে গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের মধ্যে কুষ্টিয়ায় বিএনপির সাবেক তিন সংসদ সদস্য এবং দলটির জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি যথাক্রমে সৈয়দ মেহেদী আহমেদ (রুমী), সোহরাব উদ্দীন ও রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা রয়েছেন।

বরিশালে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বিলকিস আক্তার জাহান; বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হোসেন খান।

এ ছাড়া কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শরীফুল আলম, রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান ও সদস্যসচিব মাহফুজ উন-নবী, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন নবী, দিনাজপুরে জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন, খুলনা জেলা বিএনপির আহবায়ক আমীর এজাজ খান, নড়াইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এফ এম কাইয়ুম ও পাবনায় জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মাসুদ খন্দকারসহ বিভিন্ন স্থানে দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারা দেশে এই গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকবে। যাঁরা মামলার আসামি তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে পুলিশের টানা অভিযানের মুখে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। আত্মগোপনে থেকেই ভার্চু৵য়াল সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা ও দলের অবস্থান জানিয়ে আসছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল ভার্চু৵য়াল সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, জাতীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল—ইউনিয়ন পর্যন্ত গ্রেপ্তারের যে হিড়িক চলছে; সেটি ভাষায় বলা যাবে না।