সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনের ব্যর্থতায় বিএনপির সঙ্গে থাকা দল ও জোটগুলো এখনো হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের আন্দোলন ও ভোট বর্জনের মুখে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে পেরেছেন ক্ষমতাসীনেরা। নির্বাচনের পরে সেই যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারায় আন্দোলনের প্রধান দল বিএনপির প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয়েছে শরিকদের।
যুগপৎ আন্দোলনে ব্যর্থতার পেছনে নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতা ও কৌশলগত দুর্বলতাকে কারণ হিসেবে দেখছে গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিভিন্ন জোট ও দল। তাদের নিজেদের পর্যালোচনায় চিহ্নিত করা হয়েছে এসব কারণ।
এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রায় পাঁচ মাস হতে চলেছে। এখনো যুগপৎ আন্দোলন-কর্মসূচিতে ফিরতে পারেনি বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক একাধিক দল ও জোটের দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা এখনো আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা না পাওয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা অব্যাহত রেখেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা নিজেদের দল সংগঠিত করা এবং ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি নেওয়ার প্রশ্নে আলোচনা চালাচ্ছেন।
জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারলেও যুগপৎ আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করতে পারিনি। কিছু ভুলভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা ছিল। নেতৃত্বের প্রশ্নবোধক বিষয় ছিল। ফলে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে পুলিশের হামলা ও সহিংসতার পর আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়নি।১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন
ভোটের পর কর্মসূচি না থাকায় যুগপৎ আন্দোলন থমকে গেছে। ওই আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দল ও জোট এখন যার যার মতো করে কর্মসূচি পালন করছে। গত মাসে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করেছে বিএনপি। তবে নতুনভাবে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারলেও যুগপৎ আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করতে পারিনি। কিছু ভুলভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা ছিল। নেতৃত্বের প্রশ্নবোধক বিষয় ছিল। ফলে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে পুলিশের হামলা ও সহিংসতার পর আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়নি।’
বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে যেসব দল ও জোট অংশ নেয়, এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, পাঁচ–দলীয় জোট, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট অন্যতম। এর বাইরে অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), এবি পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের দুই অংশ রয়েছে।
সভায় অংশ নেওয়া একাধিক সূত্র বলছে, দল ও জোটগুলো নিজেদের মতো পর্যালোচনা তুলে ধরেছে। আন্দোলনের জনসম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা ছিল। কৌশল নির্ধারণ ও দিকনির্দেশনারও অভাব ছিল।
গত মাসে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের বৈঠকগুলোতে দুটি বিষয়ে মূলত আলোচনা হয়। একটি হচ্ছে সম্ভাবনাময় আন্দোলন কেন সফল হলো না এবং কোথায় ঘাটতি ছিল, কেন আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা পাওয়া গেল না। সভায় যুগপৎ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে কী ধরনের আন্দোলন করা যায়, সেটি নিয়েও আলোচনা হয়।
সভায় অংশ নেওয়া একাধিক সূত্র বলছে, দল ও জোটগুলো নিজেদের মতো পর্যালোচনা তুলে ধরেছে। আন্দোলনের জনসম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা ছিল। কৌশল নির্ধারণ ও দিকনির্দেশনারও অভাব ছিল।
বিশেষ করে ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর আন্দোলন নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সমন্বয় ছিল না। বিএনপির পরিকল্পনায়ও ঘাটতি ছিল। আর আন্দোলনের মাঠে প্রতিরোধ গড়ার বদলে বিদেশি একটি রাষ্ট্রের ওপর অতিনির্ভরতা ছিল বলে মূল্যায়নে তুলে ধরে শরিকেরা।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক (নুর) প্রথম আলোকে বলেন, গণ–অভ্যুথানের সব ধরনের প্রেক্ষাপট থাকার পরেও সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বিগত আন্দোলন সফল করা যায়নি। অনেক সিদ্ধান্তের বিষয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকেরা জানতে পারত না। নির্বাচনের পরেও প্রতিরোধ চলবে এমন প্রত্যাশা ছিল। আন্দোলনে বৃহৎ অংশ বিএনপির উদ্যোগ না থাকায় তা হয়নি।
আন্দোলনের শরিকদের পক্ষ থেকে বিএনপিকে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তারা বলেছে, পরবর্তী আন্দোলনে যেতে হলে দুর্বলতার জায়গাগুলো ঠিক করে এগোতে হবে। বিএনপিকে নিজেদের মতো করে পর্যালোচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আগে শুধু বিএনপি এককভাবে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিত। এবার যুগপৎ আন্দোলনের কয়েকটা দলের প্রতিনিধি নিয়ে একটা লিয়াজোঁ কমিটি করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট। এরপর গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন পর্যন্ত লম্বা সময় ধরে নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েই আন্দোলনের কর্মসূচিতে ছিল বিভিন্ন দল ও জোট। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা না থাকায় এসব দল ও জোট এখন নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৩ সাল পুরোটা আন্দোলনে গেছে। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যুগপৎ আন্দোলন করেছি। দীর্ঘ আন্দোলনের পর সবাই দল পুনর্গঠনে জোর দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে। এখন যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন করছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী আন্দোলন পুনর্গঠন করে কিছুদিনের মধ্যে মাঠে নামবে।
যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোটগুলোর কোনো কোনো নেতা মনে করেন, জনগণের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু জনগণের মধ্যেও কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছে। এই নৈরাশ্যকে কাটিয়ে আন্দোলনে নামানোই তাদের লক্ষ্য। সে জন্য নতুন করে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করার তাগিদ দিচ্ছেন তাঁরা। এই নেতারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ঘটনায় সরকার বিব্রতকর অবস্থায় আছে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও সরকারের ওপর চাপ আছে। নির্বাচনের পরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেও সরকার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি, ফলে জনগণের মনে ক্ষোভ আছে। এসব পরিস্থিতিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার উপায় খুঁজে বের করার দিকে জোর দেওয়া হয়েছে।