বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হবে তৃণমূল বিএনপি—ভোটের আগে নতুন নিবন্ধিত দলটির চেয়ারপারসন ও মহাসচিব একাধিকবার এ কথা বলেছিলেন। নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থীও দিয়েছিল ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি। তবে ভোটের মাঠে দলটির ১৩৫ প্রার্থীর কেউই দাঁড়াতে পারেননি। কোনো আসনে জয় না পাওয়া দলটির প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে।
একই অবস্থা আরেক নতুন নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম)। ৫৩ আসনে প্রার্থী দিলেও কোনো আসনেই জিততে পারেননি বিএনএমের প্রার্থীরা। বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের প্রার্থীরা ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়তে পারেননি; বরং আলোচনায় থাকা দলটির শীর্ষ নেতারাও বড় ব্যবধানে ধরাশায়ী হয়েছেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের হয়ে বিএনপির বেশ কিছু নেতাকে আনার চেষ্টা ছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ফলে সরকারের কাছেও দল দুটির গুরুত্ব কমে যায়। শেষ পর্যন্ত বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনো আসনে ছাড় পায়নি। দল দুটির নেতারা আশ্বাস পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। সেটা হলো, দু-একটি আসনে তাদের প্রার্থীদের জেতাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে।
প্রয়াত মন্ত্রী নাজমুল হুদা প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর মেয়ে অন্তরা হুদা। তাঁকে সরিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর দলের প্রথম সম্মেলনে সভাপতি হন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরী, যিনি আমলা থেকে রাজনীতিবিদ হয়েছিলেন। তৃণমূলে আসার আগে ছিলেন বিকল্পধারায়। এবারের নির্বাচনে তিনি সিলেট-৬ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। প্রচার শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষ ত্যাগ করার চাপ দেওয়া শুরু হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। তবে বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। সোনালী আঁশ প্রতীকের শমসের মুবিন চৌধুরী ১০ হাজার ৯৩৬ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।
মনোনয়নপত্র বিক্রি ও নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার একাধিকবার বলেন, তৃণমূল বিএনপি প্রধান বিরোধী দল হবে। বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা (২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের সময় বহিষ্কৃত) তৈমুর আলম খন্দকার নিজে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
নানা বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসা তৈমুর আলম খন্দকার বিশাল ব্যবধানে হেরেছেন। তিনি পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট। শুরু থেকে শক্ত প্রার্থী হিসেবে নিজেকে দাবি করলেও বর্তমানে জামানত হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন তৈমুর আলম। এই আসনে চতুর্থবারের মতো জয় পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগের প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
তৃণমূল বিএনপি সারা দেশের ১৩৫টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। দলটির প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। দলটির বেশ কয়েকজন প্রার্থী ১০০ ভোটেরও কম পেয়েছেন। যেমন নাটোর-৪ আসনে দলটির প্রার্থী আব্দুল খালেক সরকার পেয়েছেন ৭২ ভোট।
ভোটে দলের প্রার্থীদের এমন ফলাফলের বিষয়ে কথা বলতে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। দুজনের মুঠোফোন নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে। দলটির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান সালাম মাহমুদের মুঠোফোনেও যোগাযোগ করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি।
এবারের সংসদ প্রধান বিরোধী দল হওয়ার আশার কথা শুনিয়েছিলেন আরেক নতুন নিবন্ধিত দল বিএনএমের নেতারাও। তবে দলটির প্রার্থীরা ৫৬ আসনের একটিতেও জিততে পারেননি। এই দলেরও প্রায় সব প্রার্থী জামানত হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন।
বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর ফরিদপুর-১ (মধুখালী, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা) আসনে প্রার্থী হন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান।
সব প্রার্থী রেখেই শাহ জাফরের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়। তবে নৌকার প্রার্থী আবদুর রহমানের সঙ্গে পেরে ওঠেননি শাহ আবু জাফর। তিনি ভোট প্রাপ্তির হিসাবে তৃতীয় হয়েছেন।
গত ২ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশানে দলের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনএমের মহাসচিব মো. শাহ্জাহান বলেছিলেন, ‘প্রথমবারের মতো বিরোধী দলে যাব।’
মো. শাহ্জাহান চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি পেয়েছেন ১ হাজার ৭৪ ভোট। ভোটের হিসাবে তিনি চতুর্থ হয়েছেন।
দলের প্রার্থীদের ফলাফলের বিষয়ে বিএনএমের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব এস এম আজমল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থীদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেননি। বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা তাঁদের ক্ষোভ-হতাশার কথা অন্য নেতাদের জানিয়েছেন। অসহায় হয়ে কোনো কোনো প্রার্থী নির্বাচনের আগেই মাঠ ছেড়ে দিয়েছিলেন।