আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে বলছেন, উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার দেখে মনে হচ্ছে, দলের নিজস্ব ভোটারদেরও একটি অংশ ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা নিয়ে রাজশাহী-৪ সংসদীয় আসন গঠিত। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ভোট পড়েছিল ৫৫ শতাংশ। পাঁচ মাসের কম সময়ের ব্যবধানে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এই উপজেলায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
ভোটের হার এতটা কমে যাওয়ায় বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের অনেকে। অন্যদিকে প্রথম দফার পর উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায়ও ভোটের হার খুব বেশি না বাড়ায় দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এখন ক্ষমতাসীন দলের বাইরে তেমন কেউ প্রার্থী হচ্ছেন না। ফলে মানুষ ভোট নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক
অবশ্য বিএনপি বর্জন করায় বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোটের হার কম ছিল। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, ভোটের হার ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে ভোটের এই হার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার এত কম কেন, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলের বর্জনের কারণে ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ কিছুটা কম, এটা ঠিক। কিন্তু ভোটের হার দেখে মনে হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোটারদেরও একটি অংশ ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না। আবার সাধারণ ভোটারদেরও ভোটকেন্দ্রমুখী করা সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে দলের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি সংসদ সদস্যদেরও দায় দেখছেন তাঁরা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, আইনি বাধার কারণে সংসদ সদস্যরা উপজেলা নির্বাচনে প্রচার চালাতে পারেন না। একই কারণে তাঁরা ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কোনো ভূমিকাও রাখতে পারেন না। ভোটাররা সেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না—উপজেলা নির্বাচনের গত দুটি ধাপে এমনটি দেখা গেছে। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করার চেষ্টা আছে। যে কারণে দলের পক্ষ থেকে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় নেতাদের প্রার্থী হতে বলা হয়েছিল। মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের স্বজনদের মধ্যে কেউ যাতে হঠাৎ করে প্রার্থী না হন, এমন নির্দেশনাও দলীয়ভাবে দেওয়া হয়েছিল।
২০০৮ সাল থেকে প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ আসনে জয়ী হয়ে আসছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ। গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নিজ দলেরই নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হক। উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন জাকিরুল ইসলাম। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রাজ্জাক সরকার। এই উপজেলার নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫৬ হাজারের মতো। অথচ সংসদ নির্বাচনে আবুল কালাম আজাদ এক লাখের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। একই দশা যশোরের শার্শায়ও। এই উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত সংসদ নির্বাচনে এখানে ভোট পড়েছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ।
দ্বিতীয় দফায় ১৫৬টি উপজেলা পরিষদে ভোট গ্রহণ করা হয় ২১ মে। এই নির্বাচনে অন্তত ৫টি উপজেলায় ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। ২৫ শতাংশের কম ভোট পড়া উপজেলার সংখ্যা ১২।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার ৩৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর আগে ৮ মে অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ।
বিএনপি বর্জন করায় উপজেলা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে কাউকে দলীয় প্রতীক দেয়নি আওয়ামী লীগ। যে কারণে আওয়ামী লীগের নেতারাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন।
দ্বিতীয় দফার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে রাজশাহীর বাগমারা, যশোরের শার্শা, পাবনার চাটমোহর, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ ও নোয়াখালীর সেনবাগে। অন্যদিকে নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম জনসমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন অন্তত ৮৯ জন।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা। এর পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হন ১১১ জন। এবার এখন পর্যন্ত ১৩ জন চেয়ারম্যান হয়েছেন বিনা ভোটে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার সংখ্যা কমলেও প্রার্থীরা খুব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারছেন না।
উপজেলার ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬টি উপজেলার নির্বাচনে ৭১টিতেই জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান বিপুল। প্রথম ধাপে অন্তত ৬৩টি উপজেলায় তেমন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়নি।
দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে যাঁরা ২০ শতাংশের কম সমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের একজন গাইবান্ধার পলাশবাড়ির এ কে এম মোকছেদ চৌধুরী। ইসি সূত্র জানায়, এই উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ২৩ হাজার ২০৯ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৬৭ হাজার ২৯৩ জন। মোকছেদ চৌধুরী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ১৯ হাজার ৫৯৫ ভোট পেয়ে। অর্থাৎ তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের মাত্র ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশের ভোট পেয়েছেন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৯৭৭ জনের ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ইউনুস গনি চৌধুরী। তিনি পেয়েছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ১০ শতাংশের ভোট।
এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় নির্দেশ অমান্য করে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের অনেকেই তাঁদের স্বজনদের প্রার্থী করেছিলেন। তবে স্বজনদের প্রার্থী করেও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা খুব একটা ভোটার টানতে পারেননি। দ্বিতীয় ধাপে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ১৮ জন স্বজন প্রার্থী হয়েছিলেন। এর মধ্যে নোয়াখালীর সেনবাগে সংসদ সদস্য মোরশেদ আলমের ছেলে সাইফুল আলম চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে জয় পান। ওই উপজেলায় ভোট পড়েছে ১৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ জয়ী হয়েছেন। তবে ভোট পড়েছে ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এখন ক্ষমতাসীন দলের বাইরে তেমন কেউ প্রার্থী হচ্ছেন না। ফলে মানুষ ভোট নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।