স্থানীয় যানবাহন টমটমে বৃদ্ধ আবদুল গফুর। তিনি তাঁর নাতনি ও পুত্রবধূকে অন্যত্র রেখে আসতে যাচ্ছেন। গতকাল মঙ্গলবার উখিয়ার রহমতের বিল এলাকায়
স্থানীয় যানবাহন টমটমে বৃদ্ধ আবদুল গফুর। তিনি তাঁর নাতনি ও পুত্রবধূকে অন্যত্র রেখে আসতে যাচ্ছেন। গতকাল মঙ্গলবার উখিয়ার রহমতের বিল এলাকায়

সীমান্তের ওপার থেকে কখন গুলি এসে গায়ে লাগে, সারাক্ষণ এই ভয়ে উখিয়ার গফুর

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল এলাকার বাসিন্দা আবদুল গফুর (৮৪)। এলাকার অন্য আট দশজনের মতো শান্তিতে দিন কাটছিল তাঁর। কিন্তু গত শুক্রবার রাত থেকে গুলির শব্দে আতঙ্কে সময় পার করছেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, এই জীবনে এত গুলির শব্দ আগে কখনো শোনেননি তিনি। রাতদিন থেমে থেমে গুলির শব্দ। কখন যে গুলি এসে গায়ে লাগে, সারাক্ষণ এই ভয়ে থাকেন তিনি।

উখিয়ার পালংখালীর রহমতের বিল প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা এলাকা। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে শুক্রবার রাত থেকে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে। এই সংঘর্ষের রেশ বাংলাদেশের লোকালয়ে বিরাজ করছে।

গতকাল বিকেলে রহমতের বিল এলাকার বাড়ি থেকে স্থানীয় যানবাহন টমটমে উখিয়া সদরের উদ্দেশে রওনা হতে দেখা যায় আবদুল গফুরকে। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন পাঁচ বছর বয়সী নাতনি ও পুত্রবধূ। টমটমে একটি লাগেজও দেখা যায়।

কোথায় যাচ্ছেন, জানতে চাইলে আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে গরু-ছাগল আছে। আছে সংসারের সব জিনিস। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে কোথায় আর যাবেন তিনি!

এ কথা বলতে বলতে আবদুল গফুরের দুই চোখ পানিতে টলমল করে ওঠে। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলতে থাকেন, গুলির শব্দে তাঁর নাতনি ভয়ে কেঁপে উঠছিল। অনেক সময় ভয়ে সে কান্নাও করে দিয়েছে। এ জন্য নাতনিকে উখিয়া সদরে তার নানাবাড়িতে রেখে আসবেন তিনি। তার মা–ও সেখানে থাকবেন।

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আবদুল গফুর বলেন, সমস্যাটা মিয়ানমারের। সেখানে সংঘর্ষের রেশ সীমান্তবর্তী বাংলাদেশি গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের বইতে হচ্ছে। কিন্তু তারা কেন ভুক্তভোগী হবে? হঠাৎ গুলি এসে বাংলাদেশে পড়েছে। গুলির বিকট শব্দে অনেক সময় কান চেপে রাখতে হয়। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির অবসান দরকার।

একই অবস্থা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায়। এলাকাটির বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিকের (৮০) সঙ্গে গতকাল রাতে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, এমন গোলাগুলির আওয়াজ কখনো শোনেননি। গত সোমবার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। এ ঘটনার পর তাঁদের আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে।

মোহাম্মদ রফিক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এলাকার প্রায় ছয় হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। বেশির ভাগ মানুষ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিছু মানুষ উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এই পরিস্থিতি কত দিন থাকবে, তা নিয়ে তিনিসহ এলাকার সবাই চিন্তিত।

গতকাল রাতে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শতাধিক নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের সবার চোখেমুখে আতঙ্ক লক্ষ করা যায়।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য দিল মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলটিতে ১৩৭ নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁদের খাবার দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, সীমান্তের ওপাশে মুহুর্মুহু গুলির শব্দে টেকা যাচ্ছে না। তা ছাড়া সীমান্তের ওপার থেকে এপারে মর্টার শেল ও গোলার অংশ এসে পড়ছে। ফলে তাঁদের সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের জেরে দেশটি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন ২৬৪ জন। তাঁরা দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, পুলিশ, ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য। তাঁদের মধ্যে কিছু আহত ব্যক্তিও আছেন। তাঁদের নদীপথে ফিরিয়ে নিতে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। তবে নৌপথের পরিবর্তে আকাশপথে মিয়ানমারের এই নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে দেশটিকে বিকল্প প্রস্তাব দিতে চায় বাংলাদেশ। এ নিয়ে আজ বুধবার মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে আলোচনা হওয়ার কথা।