মূল ফটকের তালা ভেঙে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশের দ্বিতীয় দিন গতকাল শুক্রবারও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীরা সেখানে এসেছেন। তাঁদের বেশির ভাগের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল, বিএনপির আন্দোলন ও সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপির লাভ–ক্ষতি নিয়ে তর্কবিতর্ক করেছেন তাঁরা। কেউ কেউ কার্যালয়ের নিচতলায় দাঁড়িয়ে ছবি ও সেলফি তুলেছেন।
এই নেতা–কর্মীদের কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনে লোকজন ভোট দিতে যায়নি। এটাই বিএনপির অর্জন। আবার কেউ কেউ বলছেন, মানুষ ভোট দিতে না গেলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। কর্মসূচি ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশই মাঠে ছিলেন না। এমন পরিস্থিতির জন্য দায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিতে হবে।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। সারা দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মী সেদিন ওই এলাকায় সমবেত হয়েছিলেন। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে নেতা–কর্মীদের সংঘর্ষে ওই মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। এরপর সংঘর্ষের ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে গ্রেপ্তার হন। এর রেশ ধরে সারা দেশে বিএনপির কয়েক হাজার নেতা–কর্মীও গ্রেপ্তার হন।
এর মধ্যে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। গত বৃহস্পতিবার নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথও হয়ে গেছে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কিছু নেতা–কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। তাতে ৭৪ দিন পর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতা–কর্মীদের পা পড়ে। ওই দিন বিকেলে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বাচন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেন।
কার্যালয় খোলার পরদিন গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নয়াপল্টনে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতা–কর্মীরা কার্যালয়ে আসছেন। কিছুক্ষণ অবস্থান নেওয়ার পর আবার তাঁরা চলে যাচ্ছেন। সকালে রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন করেন। তখন জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই কার্যালয়ে এসেছিলেন। তবে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পদস্থ কোনো নেতাকে কার্যালয়ে আসতে দেখা যায়নি।
গতকাল নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১২ জন নেতা–কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মধ্যে পল্টন থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আল আমিন বলেন, ‘আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার দায় দলের সিনিয়র নেতাদের। কারণ, তারা কর্মসূচি ঘোষণার পর আর কোনো ভূমিকা রাখেননি।’
নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় নেতা–কর্মীদের অনেকের মন ভেঙে গেছে বলে মনে করেন আল আমিন। তবে সফলতা অর্জন করতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির কার্যালয় খোলার পরপরই নয়াপল্টন এলাকায় দলের বিভিন্ন নেতার মুক্তি চেয়ে ব্যানার পোস্টার লাগিয়েছেন তাঁদের অনুসারীরা। এ বিষয়ে ছাত্রদল নেতা আল আমিন বলেন, ‘বিএনপি আছে ব্যানার পোস্টার আর ফেসবুক নিয়ে। ফেসবুকের আন্দোলন বন্ধ না হলে ফসল ঘরে তোলা যাবে না।’
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা ওমর ফারুক গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল নয়াপল্টন কার্যালয়ে আসেন। দলের প্রতি ভালোবাসা থেকে কার্যালয়ে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিএনপি টিকে আছে এটাই তো বেশি।’
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক সম্রাট মিয়াজি মনে করেন, বিএনপির বেশির ভাগ নেতা–কর্মী সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন। এ জন্যই দলের এই অবস্থা।
বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার দায় দলের নির্বাহী কমিটি ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বেশি বলে মন্তব্য করেন সম্রাট মিয়াজি। এই যুক্তির পক্ষে কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের নেতারা মিছিল করে তাঁদের যাতে ছবি পাঠানো হয়, এই নির্দেশনা দিয়েই দায় এড়িয়েছেন। ছাত্রদলের সভাপতি–সাধারণ সম্পাদক কেউ ২৮ অক্টোবরের পর মাঠে নামেননি।’
দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভুলের কারণে বিএনপির এই দশা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম। গতকাল বিকেলে নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর তিনি কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দুই বার পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। অবশ্য পুলিশকে প্রথম দফায় ৫০ হাজার, পরে ৭ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। তাঁর মতে, আন্দোলন সফল করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে নামতে হবে। সবাই এক হলে সরকার তিন মাসও টিকতে পারবে না।
নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সরকার ভুয়া বলে স্লোগান দিয়ে নেতা–কর্মীদের উজ্জীবিত করতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এই নেতা আত্মগোপনে। ক্ষোভ প্রকাশ করে রফিকুল বললেন, ‘আব্দুস সালাম এখন নিজেই ভুয়া হয়ে গেছেন।’
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা বাবুল হোসেন ও রুহুল আমিন গতকাল বিকেলে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। তাঁরা বলেন, নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি, এটাই বিএনপির সফলতা। আগামী পাঁচ বছর বিএনপি কী করবে—এমন প্রশ্নে তাঁরা বলেন, সরকার পাঁচ মাস থাকতে পারে কি না, সেটা দেখেন। কেন থাকতে পারবে না, এই প্রশ্নের অবশ্য জবাব দিতে পারেননি তাঁরা।
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৯ নম্বর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেনও নয়াপল্টন কার্যালয়ের অবস্থা দেখতে এসেছিলেন গতকাল বিকেলে। সেখানেই দাঁড়িয়েই তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তো বিএনপির আর কিছু করার নেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভদ্র আন্দোলন করে লাভ নেই। তাদের সঙ্গে তাদের মতো অভদ্রভাবে আন্দোলন করতে হবে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার বিএনপির সব পর্যায়ে নেতারা মাঠে নেমে তুমুল আন্দোলন করবেন। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর তো সবাই ঘরে ঢুকে গেলেন।