নির্বাচন প্রশ্নে দলীয় অবস্থান এখনো অস্পষ্ট সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা)। তবে দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো ধরনের ‘সমঝোতার’ নির্বাচনে যেতে ইচ্ছুক নন জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু দলের ভেতরে-বাইরের নানামুখী চাপে স্থির সিদ্ধান্তেও যেতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি রাখছে জাপা। তারই অংশ হিসেবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে গেলে মনোনয়ন ফরম তৈরি, আসনভিত্তিক প্রার্থী তালিকাসহ এ–সংক্রান্ত যত ধরনের দাপ্তরিক কার্যক্রম থাকে, তার সবই সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। এখন শুধু ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করা বাকি।
এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলকে স্বাগত জানায়নি জাতীয় পার্টি। আবার দলীয়ভাবে প্রত্যাখ্যানও করা হয়নি।
জাপার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নাকি বর্জন—এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করতে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আরও কয়েক দিন সময় নিতে পারেন। সেটি ২০ নভেম্বরের আগে হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর পরেই দ্রুত দলটির নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হতে পারে। কারণ, হাতে সময় কম। এক সপ্তাহের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি, আসনভিত্তিক প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণসহ মনোনয়ন শেষ করতে হবে। কারণ, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন।
এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলকে স্বাগত জানায়নি জাতীয় পার্টি। আবার দলীয়ভাবে প্রত্যাখ্যানও করা হয়নি। যদিও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর অনুসারী কিছু নেতা নির্বাচনে যাওয়ার কথাও বলেছেন।
দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে দলের ভেতর ও বাইরে থেকে নানামুখী চাপ আরও বাড়বে, তা ধরে নিয়েই এগোচ্ছেন নীতিনির্ধারকেরা। সে কারণে নির্বাচন বর্জন বা অংশগ্রহণের বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতা রাখা হয়েছে। যদিও নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম ছাপা, এর মূল্য নির্ধারণ এবং ফরম বিক্রির জন্য টাকা গ্রহণের রসিদও ছাপা হয়েছে। এবার মনোনয়ন ফরমের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই ফরমের মূল্য রাখা হয়েছিল ২৫ হাজার টাকা।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জন করলে জাতীয় পার্টির ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হতে পারে। আর নির্বাচনে গেলে আমাদের ওপর স্যাংশন আসতে পারে।জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে এবার নির্বাচন নিয়ে আমরা ভেবেচিন্তে পা ফেলব। আমি আবারও বলছি, এখনো নির্বাচনে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আমরা নির্বাচনে যাব নাকি যাব না, তা অল্প দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেব। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান (জি এম কাদের) সিদ্ধান্ত নেবেন।’
যদিও বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না জানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে আসছেন জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় মাঠপর্যায়ের ৫৯ জন নেতা বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে দুজন ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্তমান অবস্থায় নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দেন। সভায় সমাপনী বক্তব্যে জি এম কাদের উভয়মুখী চাপের কথা বলেন। এই অবস্থায় নির্বাচনে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়ার শঙ্কার কথাও বলেন তিনি।
অবশ্য মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দিলেও দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচনে যেতে চান। এরই মধ্যে দলীয় প্রধানকে অবহিত না করে দুই দফায় জাপার ২২ জন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর জাতীয় সংসদ ভবনের কক্ষে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এটাকে নির্বাচন সামনে রেখে দলে বিশৃঙ্খলার আভাস হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা সংসদ সদস্যদের এ তৎপরতাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না।
এবার মনোনয়ন ফরমের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই ফরমের মূল্য রাখা হয়েছিল ২৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় যুবসংহতির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সবাই ভোটে নয়, সমঝোতা করে সহজে এমপি হতে চান।’
জাপার সূত্রগুলো বলছে, দলের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন, এমন নেতারা নির্বাচনে যাওয়া না–যাওয়ার প্রশ্নে ভালোই সংকটে পড়েছেন। নির্বাচনে গেলে জনমতের বিপক্ষে যেতে হবে। আর তাতে আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে রাজনীতিতে যে বদনাম আছে, সেটি আরও দৃঢ় হবে। জনসমর্থনের দিক থেকে দল আরও দুর্বল হবে। আর এই সময়ে নির্বাচনে না গেলে শেষ বিবেচনায় দল উপকৃত হবে, জাপার জনসমর্থন বাড়বে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে নির্যাতন-হয়রানির ঝুঁকি বাড়বে। দলের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়েও টানাহেঁচড়া শুরু হতে পারে।
গত মঙ্গলবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় এমন আশঙ্কার কথা নিজেই প্রকাশ করেছেন জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জন করলে জাতীয় পার্টির ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হতে পারে। আর নির্বাচনে গেলে আমাদের ওপর স্যাংশন আসতে পারে। সরকার যদি পরবর্তী সময়ে সমস্যায় পড়ে, আমাদের মাথাতেও আঘাত আসবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এসব ভাবনায় জাপার নীতিনির্ধারকেরা নির্বাচন নিয়ে দোটানায় আছেন। যদিও রাজনৈতিক অঙ্গনে এই আলোচনাও আছে যে নিজেদের কদর বাড়ানোর জন্য জাপার নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে, যাতে নির্বাচনী সমঝোতায় চাহিদামতো আসন পাওয়া যায়। তবে জাপার নেতারা এ ধরনের তৎপরতার কথা নাকচ করে দিয়েছেন।