গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ক্ষমা পেয়েছেন নিজ দল থেকে। এখন তিনি মেয়র পদও ফিরে পেতে পারেন। এমনকি চলতি বছরের শেষের দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আবারও তাঁর দলের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে—এসব বিষয়ও আলোচনায় আসছে দলটিতে। এবার আওয়ামী লীগের ক্ষমার তালিকা বেশ লম্বা বলে দলটির সূত্রে জানা গেছে। তাহলে জাহাঙ্গীর আলমের পরে ক্ষমা পাচ্ছেন কে? এবার কি সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের পালা? মন্ত্রিসভার সদস্য পদ না হোক, তিনি কি দলের পদ ফিরে পাবেন?
আলোচনা উঠেছে, সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথকে দল থেকে যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তাঁর ভবিষ্যৎ কী? কিংবা রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালীর সাময়িক বরখাস্ত মেয়র আব্বাস আলীর কপালে কী আছে? এসব প্রশ্নে এখন নানা আলোচনা রয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে।
আওয়ামী লীগ অতীতেও বহুবার দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া বা অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের দলে ফিরিয়ে নিয়েছে। এবারও দলটির উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বহিষ্কৃত নেতা–কর্মীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর দলের জাতীয় কমিটির সভায় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া দলীয় নেতাদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দল থেকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা আসার আগেই গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলমসহ শতাধিক দলীয় নেতা তাঁদের দোষ স্বীকার করে দলের সাধারণ সম্পাদক বরাবর ক্ষমার আবেদন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সেই ১৭ ডিসেম্বরের বৈঠকেই আবেদনকারীদের ক্ষমা করা হয়। দলের ক্ষমা করার সেই চিঠি এখন পাঠানো হচ্ছে ক্ষমাপ্রাপ্তদের কাছে।
তবে দল থেকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পর সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান আবেদন করেছেন। প্রতিদিনই সারা দেশ থেকে বহিষ্কৃত নেতারা ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সূত্র বলছে, ১৭ ডিসেম্বরের দলীয় সিদ্ধান্তের পরও যাঁরা আবেদন করবেন, তাঁদেরও ক্ষমা করা হবে।
জাহাঙ্গীরসহ আলোচিতরা বহিষ্কার হয়েছিলেন যে কারণে
২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গাজীপুর জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন তিনি। এরপর তাঁকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
জাহাঙ্গীর আলমের কিছুদিন পরই অশালীন ও নারীর প্রতি অবমাননাকর কথা বলে মন্ত্রিত্ব ও দলের পদ হারান সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। জাহাঙ্গীর আলমের আগে রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতা করে দেওয়া বক্তব্য গোপনে ধারণ করে ছেড়ে দেওয়ার পর। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠানো হয়। মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। এখন তিনি জামিনে মুক্ত।
এর আগে পবিত্র হজসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে ২০১৪ সালে প্রথমে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন লতিফ সিদ্দিকী। তখন তাঁকে দলের সভাপতিমণ্ডলী ও সাধারণ সদস্য পদ থেকেও বাদ দেওয়া হয়। দলের চাপে তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সে সময় লতিফ সিদ্দিকী দলের সাধারণ সদস্য পদটি বহাল রাখার অনুরোধ করলে তা প্রত্যাখ্যান করে দল। এর পর থেকে তিনি রাজনীতি থেকে আড়ালেই আছেন।
লতিফ সিদ্দিকীর দলে ফেরার সম্ভাবনা দেখেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। মুরাদ হাসান ও কাটাখালীর মেয়রের ভাগ্যও শিগগিরই খুলবে বলে মনে করছেন না তাঁরা। পঙ্কজ নাথ সংসদ সদস্য পদ থাকলেও দলে তাঁর পদ-পদবি কবে জুটবে, এই বিষয়েও নিশ্চিত নন কেউ। তাঁদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমকে ভাগ্যবান বলেই মনে করছেন দলের নেতারা।
বহিষ্কার করার নিয়ম এবং শাস্তি
আওয়ামী লীগের দপ্তরের তথ্য হচ্ছে, গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটি থেকে যাঁদের বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এর প্রায় ৯৯ শতাংশ কিংবা এরও বেশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর আলম, মুরাদ হাসান, রাজশাহীর পবার আব্বাস আলীর বিষয়টি ভিন্ন। তাঁরা ‘অশালীন’ বক্তব্য দিয়ে শাস্তির শিকার হন। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে আশালীন বক্তব্য দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম মাপ পেলে অন্যদের কী হবে? এ ছাড়া পঙ্কজ নাথকে দলের সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল দলীয় কোন্দলের কারণে। কারণ, যা–ই হোক না কেন আওয়ামী লীগে শাস্তি দেওয়ার বিধান মোটামুটি সবই একই ধারায় হয়।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ নম্বর ধারায় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা শিরোনামে একটি ধারা আছে। এর ১১টি উপধারায় অপরাধের শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া, শাস্তির কথা বলা রয়েছে। একইসঙ্গে শাস্তির ব্যাপারে আপিল এবং ক্ষমা করার বিষয় উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ৪৭(১) ধারায় বলা হয়েছে—কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করলে তাঁর বিরুদ্ধে যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগেও দল ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এ ছাড়া ৪৭ (১১) এ বলা আছে—জাতীয় সংসদ কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তদন্ত করে বহিষ্কার করা হবে।
এ ছাড়া সব অপরাধ বা বহিষ্কার থেকে মুক্তি দেওয়ার এখতিয়ার দলের জাতীয় কমিটির বলে ৪৭ (২) ধারায় উল্লেখ আছে গঠনতন্ত্রে। গঠনতন্ত্রের ১৭(৬) ধারায় জাতীয় কমিটির ওপরই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি দলটির ১৮০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটিরও সভাপতি। কেন্দ্রীয় কমিটির ৮১ সদস্য, ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা থেকে একজন এবং সভাপতি নির্বাচিত ২১ জন মিলে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচনে বিরোধিতা কিংবা অন্য যেকোনো অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয় ৪৭(১) ধারা মতে। আর ক্ষমা করা হয় ৪৭(২) ও ১৭ (৬) ধারা মতে। সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীর আলমও ২০২১ সালে এই দুই ধারার ওপর ভিত্তি করে শাস্তি পেয়েছিলেন এবং এখন ক্ষমা পেলেন।
এর মধ্যে মুরাদ হাসান ক্ষমা পেতে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আবেদন করেছেন। আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথকে। দল থেকে তাঁকে কারণ দর্শানোরও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সাংগঠনিক রীতি অনুসারে, কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবের পর দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার কিংবা দলে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। পঙ্কজ নাথ বরিশাল আওয়ামী লীগের ২৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের একজন। কাটাখালীর মেয়র আব্বাস আলী পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও রাজশাহী জেলা কমিটির নির্বাহী সদস্য ছিলেন।
যে কারণে ক্ষমা
শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কারের পর দলে ফিরে নেওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ গত ১৪ বছরের শাসনামলে বহুবার এমন নজির স্থাপন করেছে।
এবার ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের সপ্তাহখানেক আগে। একইভাবে ২০১৬ সালে দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের আগে এক জাতীয় কমিটির বৈঠকে একইভাবে বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল।
সেবার প্রথম ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় নিহত হন ১১৬ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন ৭১ জন। তাঁদের বেশির ভাগই মারা গেছেন দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে মারামারিতে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ এক মূল্যায়নে দেখা গেছে, ইউপি ভোটে প্রতি তিনজন দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। বিদ্রোহীদের কারণেই এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে দলটির ভেতরে আলোচনা ছিল। এরপরও সে সময় সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এতে বিপুলসংখ্যায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। গঠনতন্ত্র মোতাবেক সবাই সাময়িক বহিষ্কার হন। এমন বহিষ্কার নেতার সংখ্যা কয়েক শ বলে আওয়ামী লীগের ভেতর আলোচনা আছে।
একটা হিসেবে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীসহ নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৩০৪ জন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়ী হন ১৩৬ জন, তাঁরা মূলত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৫ জন সাংসদ বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা বা সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ ছিল। অর্থাৎ ১৩৬ জন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। একই দশা স্থানীয় সরকারের অন্য নির্বাচনেও।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন লক্ষ্য রেখেই বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের ক্ষমা করা হয়েছে। কারণ, যাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাঁদের প্রায় সবাই দলের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নেতা ছিলেন। এত বিপুলসংখ্যায় জনপ্রতিনিধি ও নেতাকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কিংবা বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁদের ফিরিয়ে আনার কারণেও দলের অন্যদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে তাঁদের দলের বাইরে রাখলে যে ক্ষতি হতো এর চেয়ে কম হবেই বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই প্রভাবশালী, টাকাওয়ালা হয়ে গেছেন। তাঁদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের সখ্য আছে। তাঁদের শাস্তি দিয়ে বাইরে রাখা কঠিন। ফলে প্রভাব কম কিংবা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়দের দলের বাইরে রাখার কোনো অর্থ নেই। এ জন্য সাধারণ ক্ষমা দলের উপকারে আসবে, যা আগামী নির্বাচনে কাজে দেবে। ওই নেতা আরও বলেন, নেতারা বরখাস্ত হওয়ার পর তৃণমূলের বেশির ভাগ স্থানে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি হয়ে গেছে। ফলে তাঁরা স্বপদে আর ফিরতে পারছেন না। এর জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। এটাই তাঁদের মূল শাস্তি হিসেবে গণ্য হয়েছে।