চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে বিএনপি 

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে ২৭ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয় বিএনপি। যুগপৎ কর্মসূচি দিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চসহ ৩৬ দল ও জোট। 

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘তারুণ্যের সমাবেশে’ অংশ নেওয়া নেতা–কর্মীদের একাংশ। বিএনপির তিনটি সংগঠন এ সমাবেশের আয়োজন করে। গতকাল বেলা সোয়া তিনটায়

সরকার পতনের দাবিতে এবার ঢাকায় ২৭ জুলাই মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। গতকাল শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের সমাবেশ থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

একই দিন যুগপৎভাবে মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২–দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরামসহ ৩৬টি রাজনৈতিক দল ও জোট। গতকাল বিকেলে বিএনপির কর্মসূচি ঘোষণার কাছাকাছি সময় এসব দল ও জোট পৃথক সংবাদ সম্মেলন ও বিবৃতি দিয়ে ২৭ জুলাই ঢাকায় পৃথকভাবে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের সমাবেশের চার দিনের মাথায় আবার ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।

এর আগে ১২ জুলাই বিএনপি এবং দলটির যুগপৎ আন্দোলনের শরিকেরা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ‘এক দফা’ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। এরপর ঢাকাসহ সারা দেশে দুই দিনের পদযাত্রার পর গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের সমাবেশ করে বড় ধরনের জমায়েত করল দলটি। এই জমায়েত থেকে ২৭ জুলাইয়ের মহাসমাবেশের ঘোষণা আসে। সরকার পতনের এক দফা ঘোষণার দুই সপ্তাহের মাথায় ঢাকার এই মহাসমাবেশ বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলনের সূত্রপাত কি না, সে আলোচনাও শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। 

গতকাল তারুণ্যের সমাবেশে ২৭ জুলাই মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দফা এক, দাবি এক; শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’ এ সময় সমবেত নেতা-কর্মীরাও ‘দফা এক, দাবি এক; শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ স্লোগান দিতে থাকেন।

জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল গতকালের তারুণ্যের সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে তিন সংগঠনের ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা অংশ নেন। এর আগে পাঁচটি বড় শহরে তারুণ্যের সমাবেশ হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই সমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী অংশ নেন। একপর্যায়ে উদ্যান ছাড়িয়ে নেতা-কর্মীরা রমনা পার্ক, শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন সড়কে ছড়িয়ে পড়েন। এ সময় আশপাশের সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। 

এই সমাবেশ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ, মৎস্য ভবন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। জলকামান, সাঁজোয়া যান, প্রিজন ভ্যানের গাড়িও দেখা গেছে শাহবাগ ও মৎস্য ভবনের সামনে। 

সুষ্ঠু নির্বাচনে ভয় পায় আওয়ামী লীগ

সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কখনো জয়ী হতে পারবে না। এখন যদি নির্বাচন হয়, তাহলে তারা ১০টার বেশি আসন পাবে না। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভয় পায়। ভয় পায় বলেই তারা ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। আর নিরপেক্ষ নির্বাচনে কখনো জয়ী হতে পারবে না। এটি নিশ্চিত হয়েই তারা সংবিধান থেকে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। 

মির্জা ফখরুল বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া এবার এই দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। ৩৬টি দল যুগপৎভাবে ঘোষণা দিয়েছে, সবাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন চায়। সে জন্য অবিলম্বে শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তিনি বলেন, শুধু বিএনপি নয়, জাতীয় পার্টি ও চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলনও পরিষ্কার করে বলেছে, এই সরকারে অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও বলেছে, অন্যান্য দলও বলেছে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই কালবিলম্ব না করে সরকারকে পদত্যাগ করতে আহ্বান জানান তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, গত ১৪-১৫ বছরে এই সরকার বাংলাদেশের যে ক্ষতি করেছে, অতীতে আর কখনো এমন ক্ষতি হয়নি। এ দেশের মানুষ ভোট দিতে চায়, কথা বলতে চায়, এই দেশের লেখক-সাংবাদিকেরা লিখতে চান; এসব অধিকার কেড়ে নিয়ে এই সরকার একটি অলিখিত একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল চালু করেছে। 

এত মামলা দেন কেন?

বিএনপির মহাসচিব বলেন, তারা নির্বাচনে ভয় পায়। বিএনপি যাতে নির্বাচন করতে না পারে, সে জন্য তারা নেতা-কর্মীদের নামে একটার পর একটা মিথ্যা মামলা দিয়ে যাচ্ছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা দিয়েছে। এমন লোক নেই, যার বিরুদ্ধে মামলা নেই। 

আবারও ‘গায়েবি’ মামলা দেওয়ার অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এত মামলা দেন কেন? কারণ আপনারা ভয় পান বিএনপিকে।’ তিনি বলেন, ২০১৮ সালে নির্বাচন শুরুর আগে থেকেই যেভাবে মামলা দেওয়া শুরু করেছিল, আজকে আবার একই কায়দায় গায়েবি মামলা শুরু করেছে; যাতে বিএনপি নির্বাচনের পূর্বে মাঠে আসতে না পারে। 

ভোটের আলামত দেখা গেছে ঢাকা-১৭ আসনে

বর্তমান সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সমালোচনা করতে গিয়ে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের প্রসঙ্গ তোলেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘এবারকার ভোটের আলামত আমরা সেই দিন দেখলাম ঢাকা-১৭ আসনে। দেখেছেন না হিরো আলমকে। বেচারা হিরো আলম। বাচ্চা ছেলে, আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। সে একটা আশা নিয়ে গিয়েছিল যে অন্তত তাকে ভোটটা করতে দেবে। কিন্তু এটা যে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই দল, যারা কাউকে সহ্য করতে পারে না। ওরা মনে করে এই দেশ তাদের বাপের তালুকদারি। অথচ ২০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ।’

গত সপ্তাহে রাজধানীর উত্তরা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিএনপির নেতা কবির হোসেনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেন ফখরুল। তিনি বলেন, ১৬ ঘণ্টা পর চোখ বাঁধা অবস্থায় তাঁকে বাসার সামনে ফেলে গেছে। র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তারপরও এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই, ভয় দেখিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা। 

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তারা ডিসি-এসপিদের পছন্দমতো নিয়োগ দিচ্ছে। উদ্দেশ্য কী, দিনের আলোয় তারা কৌশল করে সিল মেরে আবার নিয়ে যাবে। কিন্তু বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার আর সেটা হবে না।’

সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

ভোট দিতে না পারা ও চাকরিচ্যুত কয়েকজন বক্তব্য দেন

তারুণ্যের এই সমাবেশে ‘গুমের শিকার’ নেতা-কর্মীদের পরিবারের সদস্য, ভোটার হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত ভোট দিতে না পারা তরুণ-তরুণী এবং বর্তমান সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত ও চাকরিবঞ্চিত কয়েকজন বক্তব্য দেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন তরুণ আইনজীবী খন্দকার আসমা হামিদ, জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উল্লেখ করে পত্রিকায় নিবন্ধ লেখার দায়ে চাকরিচ্যুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোরশেদ হাসান খান, চাকরিচ্যুত চিকিৎসক সানসিলা জেবরিন, নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম (কাজল)।

সমাবেশে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, কুমিল্লার মোস্তাক মিয়া, ফরিদপুরের শামা ওবায়েদ ও ময়মনসিংহের সৈয়দ এমরান সালেহ বক্তব্য দেন। 

সভাপতির বক্তব্যে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে শপথ করছি, শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত, ৪ কোটি ৭০ লাখ তরুণ ভোটারের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত, বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত না করা পর্যন্ত রাজপথ ছেড়ে যাব না।’

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানি, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম প্রমুখ। 

সমাবেশের প্রথম পর্বে ছিল তরুণ শিল্পীদের গণসংগীত পরিবেশনা। এই অনুষ্ঠান চলাকালে বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে মঞ্চে শিল্পীদের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী উঠলে হঠাৎ মঞ্চটি ধসে পড়ে। পরে একটি পিকআপ এনে অস্থায়ী মঞ্চে কয়েকটি চেয়ার বসিয়ে বেলা সাড়ে তিনটায় সমাবেশ শুরু হয়। শেষ হয় পৌনে ছয়টায়।

তারুণ্যের সমাবেশে ছাত্র-যুবকদের বিপুল উপস্থিতি উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এই সমাবেশ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি, এই সমাবেশ থেকে আত্মবিশ্বাসী হয়েছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, আজকে আবার এই তরুণেরা একইভাবে দেশকে, দেশের মানুষকে, গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করেছে।’