এবার উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অনেক লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটি তাদের দলীয় কোন্দল ঠেকানোর চিন্তার কথা প্রকাশ্যে বলছে। তবে এর মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কিছুটা বেকায়দায় বা ‘ট্র্যাপে’ ফেলার পরিকল্পনাও আছে ক্ষমতাসীনদের।
অন্যদিকে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর বিএনপি উপজেলা বা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করলে তাদের দলের অনেকেই স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিতে পারেন। আবার নির্বাচনে অংশ নিলে সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল, এমনটা প্রমাণিত হবে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি আওয়ামী লীগের তৃণমূল। কারণ, দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ এবং টাকাপয়সা খরচ করতে হবে না।
জামায়াতে ইসলামীও উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। অবশ্য আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টি অংশ নেবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, আগামী এক বছরজুড়ে সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্য বিরোধী দলগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিলে তারা আর সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেতে পারবে না। আবার বিরোধীরা বর্জন করলে তাদের দলের নেতারা নিজ উদ্যোগে নির্বাচনে অংশ নেবেন। দলও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এতে তৃণমূলে বিএনপি আরও দুর্বল হবে। এমনটা ভাবছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি আওয়ামী লীগের তৃণমূল। কারণ, দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ এবং টাকাপয়সা খরচ করতে হবে না। এতে দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সক্রিয় নেতাদের জয়ী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অনেক ভেবেচিন্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর পেছনে শুধু আওয়ামী লীগের স্বার্থ নয়, বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্যও রয়েছে।
২০১৯ সালে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৪৭৩ উপজেলার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ৩২০টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। এর মধ্যে ১১৫ জন নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হন ১৩৬ জন, যার প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্র বলছে, দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জোর করে বসিয়ে দেন। এ জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যান অনেকে। এভাবে জয়ের ফলে দেশে–বিদেশে নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়।
খুলনা জেলার একজন উপজেলা চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতীক দিলে দলের লোকজনই নৌকাকে হারাতে উঠেপড়ে লাগে। এতে দলে কোন্দল হয়। প্রতীক না থাকাই ভালো।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্র বলছে, দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জোর করে বসিয়ে দেন। এ জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যান অনেকে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় এবং জাল ভোট পড়া বন্ধে চেষ্টা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে ভোটার উপস্থিতি কম হলেও ভোট নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক হয়নি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পুনরায় জাল ভোট ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ফিরে এলে বদনাম হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। প্রতীক না দেওয়ার পেছনে এই বিবেচনাও কাজ করেছে।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদ উল্যাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে নির্বাচন আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। এতে ভোটারের উপস্থিতিও বাড়বে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরুর পর চেয়ারম্যান ও মেয়র পদ টাকাওয়ালাদের হাতে চলে যায় বলে অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগে। দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নৌকা প্রতীক মানেই জয় নিশ্চিত মনে করতেন ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালারা। ফলে চড়া দামে মনোনয়ন কেনার অভিযোগও আছে। এতে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী ও কম টাকাওয়ালারা আর প্রার্থী হতে পারছিলেন না। এবার এ ধারা বন্ধ হবে বলে তাঁরা মনে করছেন।
‘সংসদ নির্বাচনে ভোট না দিয়ে জনগণ এই সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়েছে। এখন এই নির্বাচনে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ, সেটি কমে যাবে এবং তাতে সরকারের রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্ন এসে যাবে। তাই আমরা উপজেলা নির্বাচনে যাব না।’আশরাফ আলী আকন, আমিরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অনেকের মূল্যায়ন হচ্ছে, স্থানীয় সরকারে প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের কারণে দলে অনুপ্রবেশ বেড়েছে। রাজনীতি করেননি কিন্তু দলীয় সংসদ সদস্যের আশীর্বাদপুষ্ট অনেকে জনপ্রিয়তা না থাকলেও মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের পেছনে আগ্রহীদের ধরনা দিতে হয়।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন আখলাক হায়দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলের এই সিদ্ধান্তে তিনি খুশি। কারণ, জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। অথচ দলীয় প্রার্থীর চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়ে জয়ী হন। প্রতীক না থাকায় এবার দলের বিরুদ্ধে যেতে হবে না।
নির্বাচন কমিশন বলছে, আইনে থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এতে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দলীয় প্রতীক না দেওয়ার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দলে বিভেদ যাতে না হয়, সেটা একটা লক্ষ্য ছিল। এ ছাড়া বিএনপির নেতারা যদি ভোটে আসতে চান, তাহলে দলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।
সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে এখনো দলের কোনো পর্যায়ে আলোচনা করেনি বিএনপি। ফলে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি।’
দলে বিভেদ যাতে না হয়, সেটা একটা লক্ষ্য ছিল। এ ছাড়া বিএনপির নেতারা যদি ভোটে আসতে চান, তাহলে দলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম
তবে বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বেশ বেকায়দা অবস্থায় পড়ছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা বর্জন—দুটোই তাদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর কোন যুক্তিতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে। কারণ, এই নির্বাচনে অংশ নিলে প্রকারান্তরে বিরোধীদের কাছ থেকে সরকার বৈধতা পেয়ে যায়। অন্যদিকে টানা সব নির্বাচন বর্জনের প্রভাব দলের তৃণমূলে কী হবে, তা নিয়েও চিন্তায় আছেন নীতিনির্ধারকেরা।
সংসদ নির্বাচনে ভোট না দিয়ে জনগণ এই সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়েছে। এখন এই নির্বাচনে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ, সেটি কমে যাবে এবং তাতে সরকারের রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্ন এসে যাবে। তাই আমরা উপজেলা নির্বাচনে যাব না।আশরাফ আলী আকন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি নেই। পবিত্র রমজানের আগে বড় কর্মসূচির বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়নি। ফলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিলে সারা দেশের নেতা-কর্মীরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার একটি সুযোগ পাবেন। সে বিবেচনায় কেউ কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে।
জামায়াতে ইসলামীও উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ২০ জানুয়ারি দলটির কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার বৈঠক হয়েছে। মজলিশে শুরা জামায়াতের নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ পর্ষদ। শুরার বৈঠকে সদস্যরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানা গেছে। দলটির উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, মাঠপর্যায়ের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে তাঁরা উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তবে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনও বর্জনের চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। দলটির নেতারা বলছেন, বিগত সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাঁদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এই দলের আমিরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আশরাফ আলী আকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনে ভোট না দিয়ে জনগণ এই সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়েছে। এখন এই নির্বাচনে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ, সেটি কমে যাবে এবং তাতে সরকারের রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্ন এসে যাবে। তাই আমরা উপজেলা নির্বাচনে যাব না।’