স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিজের লোক বলেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তাঁদের সংসদে স্বতন্ত্র হিসেবে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অপরদিকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আনুপাতিক হারে তাঁদের প্রাপ্য সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচনের ভার প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
আজ রোববার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। সেখানে এসব আলোচনা হয় বলে বৈঠক-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আগামীকাল সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনের ২১২ নম্বর কক্ষে গিয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচনের এখতিয়ার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে দেওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করবেন। সেখানে এ-সংক্রান্ত নথিতে সই করবেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫৯ জন আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক। ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের নিজের এবং স্বতন্ত্র মিলে পাবে ৪৮টি আসন।
আজ বৈঠকের শুরুতেই প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সূচনা বক্তব্য দেন। এরপর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বৈঠকটি পরিচালনা করেন সংসদের চিফ হুইপ নূর আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী)। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা সবাই আওয়ামী লীগের। কেউ যুবলীগ, কেউ আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সংগঠন করেন। সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।’ তিনি বলেন, একাদশ সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচনের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবারও ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার কথা বলেন। এ সময় অন্য সদস্যরাও ‘হ্যাঁ’ বলে সম্মতি জানান।
এ সময় শেখ হাসিনা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটা ভালোই হলো। এবার আরও বেশি লোককে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য করা যাবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী পরিবার রয়েছে। অনেক নেতা অকালে মারা গেছেন। তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা আছেন। পেশাজীবীদের মধ্য থেকেও কাউকে কাউকে সংসদ সদস্য করা দরকার। এর মাধ্যমে ত্যাগীদের একটা স্বীকৃতি দেওয়া যাবে।
উপস্থিত সংসদ সদস্যরা তাঁদের বক্তব্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশনা পেয়েই তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু দলে তাঁদের পদপদবি ও অবস্থান আছে। এখন তাঁরা সংসদে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে চান।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র সব সংসদ সদস্যই তাঁর। একটা ডান হাত, অন্যটা বাম হাত। বলা যায়, এ-টিম ও বি-টিম।
তবে সংসদে সবাইকে স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে স্বতন্ত্র থাকার লাভ আছে। কারণ, সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা বিলের ওপর সমালোচনা বা দোষ-ত্রুটি তুলে ধরেন না। স্বতন্ত্র সদস্যরা এই কাজ ভালোভাবে করতে পারবেন। এতে দেশও লাভবান হবে।
স্বতন্ত্র সদস্যদের কেউ কেউ বলেছেন, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ মনোনীত পরাজিত প্রার্থীরা তাঁদের দলের লোক মনে করছেন না। এ নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে।
এই পর্যায়ে শেখ হাসিনা বলেন, এলাকায় সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে হবে। কোনো ধরনের সংঘাতে যাওয়া যাবে না। তিনি বিষয়গুলো দেখবেন এবং অচিরেই সমাধান হয়ে যাবে বলে জানান।
বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গাজীপুর-৫ আসনের আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্বে দায়িত্ব পালনরত নারীদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ। জার্মানির আঙ্গেলা ম্যার্কেলের পর এখন শেখ হাসিনা বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান তাঁর বক্তৃতার সময় প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘আমি তো আপনার দলের নই।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তুমিও আমার’। এরপর একরামুজ্জামান বলেন, ‘আমি তো বিএনপি থেকে এসেছি।’ তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সবই জানি। সবাই আমার লোক।’
বৈঠকে উপস্থিত সূত্র আরও জানায়, স্বতন্ত্র দুই সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও বক্তৃতা করেননি। আর প্রায় সবাই কম-বেশি বক্তব্য দেন। শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের অনেক বক্তব্যের জবাবও দেন।
বৈঠক শেষে রাত সাড়ে ৯টার দিকে গণভবনের ফটকের সামনে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘স্বতন্ত্ররা স্বতন্ত্রই থাকবেন। তবে তাঁরা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন। এই একটা বিষয় আমাদের সংসদ নেতা, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কারভাবে বলেছেন।’
সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁদের মনোনীত করবেন, তাঁদের প্রতি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সমর্থন থাকবে।