উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের স্বজনদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারছে না আওয়ামী লীগ। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময়েও তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারেনি দলটি। এখন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে। চেষ্টা চালিয়ে যাবেন তাঁরা। কিন্তু এতে কতটা কাজ দেবে—দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ নিয়ে সন্দিহান।
৮ মে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোট হবে। আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত দলের দপ্তরে ৫০ জনের বেশি মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের স্বজনদের তথ্য এসেছে; যাঁদের প্রায় সবাই কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন।
তবে দলীয় সিদ্ধান্ত দেরিতে নেওয়ার কারণে ছেলেকে ভোট থেকে সরানো যাচ্ছে না বলে অপারগতা প্রকাশ করেন শাজাহান খান। তখন ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করা শাজাহান খানের রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তখন উচ্চ কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেন শাজাহান খান।
ভোটের আগের দিন পর্যন্ত সরে যাওয়ার সুযোগ আছে, এমন কথা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বললেও তা মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও তাঁদের স্বজনেরা মানবেন—এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; বরং মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা অনড় অবস্থান প্রকাশ করে যাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার রাতে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে স্বজনের ভোট থেকে সরে যাওয়া নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের মধ্যে উচ্চ কণ্ঠে বিতর্কও হয়েছে।
শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট করছেন। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম দলের নির্দেশনা পেয়ে ১৮ এপ্রিলই শাজাহান খানকে ফোন করে তাঁর ছেলেকে ভোট থেকে সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মঙ্গলবার শাজাহান খান ধানমন্ডি কার্যালয়ে এলে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার বিষয়টি আবারও জানিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত দেরিতে নেওয়ার কারণে ছেলেকে ভোট থেকে সরানো যাচ্ছে না বলে অপারগতা প্রকাশ করেন শাজাহান খান। তখন ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করা শাজাহান খানের রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তখন উচ্চ কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেন শাজাহান খান।
প্রথম পর্যায়ের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় চলে গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, বিষয়টি আরও আগে অবহিত হলে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সুবিধা হতো। তারপরও প্রত্যাহার কেউ কেউ করেছেন, কেউ কেউ করেননি। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের যে সময়সীমা, এর পরেও ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে।ওবায়দুল কাদের
গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ওবায়দুল কাদের। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যাঁরা ভোটে রয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে আওয়ামী লীগ কি করবে-এ প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, দলীয় নির্দেশনা অমান্য করলে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের ব্যাপারে চিন্তা করা হবে। সময়মতো এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই নেওয়া হবে।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় চলে গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, বিষয়টি আরও আগে অবহিত হলে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সুবিধা হতো। তারপরও প্রত্যাহার কেউ কেউ করেছেন, কেউ কেউ করেননি। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের যে সময়সীমা, এর পরেও ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে।’
আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, দলের নির্দেশনা অমান্য করার জন্য মন্ত্রী ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের কারও শাস্তি হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে এমন নজির নেই। ফলে স্বজনদের উপজেলা ভোটে দাঁড় করানোর কারণে সংসদ সদস্যদের কারও দলীয় পদ যাবে-এমনটা ভাবার অবকাশ নেই।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় সিদ্ধান্ত যাঁরা অমান্য করেছেন, তাঁদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগের এই নীতিনির্ধারক। তিনি বলেন, ‘দল যার যার কর্মকাণ্ড বিচার করবে। চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত যাঁরা (প্রার্থিতা) প্রত্যাহার করবেন না, সময়মতো দল ব্যবস্থা নেবে।’
আওয়ামী লীগের ভেতর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগে যদি শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ত, তাহলে কীভাবে টানা চার মেয়াদে সরকারে আছে?
সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এই কথা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বললেও সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলটির কঠোর হওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর চারজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাঁদের স্বজনেরা দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করেছেন, এর মধ্যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আছেন দুজন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন দুজন। এর মধ্যে নাটোরের সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে নরসিংদীর মনোহরদীতে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ভাই নজরুল মজিদ মাহমুদ প্রার্থী রয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, দলের নির্দেশনা অমান্য করার জন্য মন্ত্রী ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের কারও শাস্তি হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে এমন নজির নেই। ফলে স্বজনদের উপজেলা ভোটে দাঁড় করানোর কারণে সংসদ সদস্যদের কারও দলীয় পদ যাবে-এমনটা ভাবার অবকাশ নেই।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্যরা এমনভাবে দলকে পরিবারতন্ত্রে আবদ্ধ করে ফেলেছেন যে অন্যদের সুযোগই দিতে চাইছেন না। নোয়াখালী সদর আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার শিউলী কবিরহাট উপজেলার টানা তিনবারের চেয়ারম্যান। চতুর্থ ধাপে এই উপজেলার নির্বাচনে আবার তাঁর প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাঁদের ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী এবার সুবর্ণচর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী। নিজে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ছেলে গাজী গোলাম মুর্তজা সহসভাপতি। স্ত্রী হাসিনা গাজী তারাবো পৌরসভার মেয়র এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এবার ছেলেকে রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করেছেন।
আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়েছে। কিন্তু ৫৯ মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ ছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দুবার বহিষ্কার করে দুবারই ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের উদাহরণের পটভূমিতে উপজেলা নির্বাচন ঘিরে দলের নির্দেশনাকে সংসদ সদস্যরা খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না, আওয়ামী লীগের নেতাদেরই অনেকে এমনটা মনে করেন।