১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর থেকেই ক্ষমতা দখলের উপলক্ষ খুঁজছিলেন এরশাদ। মন্ত্রীর বাড়িতে কুখ্যাত খুনি ইমদু ধরা পড়ার পর সেই উপলক্ষ পেয়েছিলেন এরশাদ। কি ঘটেছিল সে সময়? এরশাদের সামরিক শাসন জারির সেই দিনটির কথা মনে রেখে লেখাটি পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হন ১৯৮১ সালের ৩০ মে। আর তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। জিয়া নিহত হওয়ার পর থেকেই সামরিক শাসন জারি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তবে এ জন্য দরকার ছিল একটা উপলক্ষের। সেই উপলক্ষ তৈরি হয় ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন যুব প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসা থেকে আটক করা হয় কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইমদাদুল হক ইমদুকে। তখন নতুন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সেই ঘটনার তিন দিন পরে, ১১ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে পুরো মন্ত্রিসভা বাতিল করেন তিনি। আর এর প্রায় দেড় মাসের মধ্যে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন জেনারেল এরশাদ।
কালীগঞ্জের ইমদু যুবদল করতেন। তিনি যখন মন্ত্রীর বাড়ি থেকে আটক হন, তখন ক্ষমতায় বিএনপি সরকার। তারপরও মিন্টো রোডের মন্ত্রীর বাসা থেকে ইমদুকে আটক করা হয়েছিল বিশাল আয়োজন করে। রীতিমতো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। সেই ইমদুকে আটক করার ঘটনা নিয়ে এখনো আছে নানা ধরনের জল্পনা–কল্পনা। অনেকে একে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেও দেখেন। একটা প্রচলিত ধারণা হচ্ছে ঘটনাটি আসলে ঘটানো হয়েছিল, অনেক কিছুই পূর্বপরিকল্পিত, যাতে সামরিক শাসন জারি করা সহজ হয়।
আসলে সেদিন কী ঘটেছিল? কীভাবে আটক হয়েছিলেন ইমদু? সেই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিরা কী বলছেন? আর জেনারেল এরশাদই–বা কী করেছিলেন তখন? ঘটনার ৪০ বছর পরে সবার বক্তব্য এক জায়গায় করলে নতুন কোনো উপসংহারে আসা যায় কি না, সেটাই বরং দেখা যাক।
ইমদাদুল হক ওরফে ইমদুর বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার সাতানিপাড়া গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাসদের ক্যাডারে পরিণত হন। মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ত্র জমা দেননি। ইমদুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন আরেক স্থানীয় জাসদ নেতা কালীগঞ্জের তুমুলিয়া গ্রামের আলী হোসেন। ১৯৭৯ সালে ইমদু যুব উন্নয়নমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসায় গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুবদলে যোগদান করেছিলেন। ফলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন ইমদু।
এক পুলিশ কর্মকর্তা ইমদুর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘গাজীপুরের কামারিয়া গ্রামের মিলন ছিল ইমদুর বন্ধু। মিলনের বাবা কাদের মোক্তারের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ছিল পাশের গ্রামের আফসার উদ্দিনের ছেলে আজিজ, মজিদ গংয়ের। বিরোধের জেরে মিলন তার বন্ধু ইমদু, বরজুল এবং মোস্তফাকে নিয়ে এক রাতে আজিজকে হত্যা করে লাশ নিয়ে বিলে পুঁতে রাখে। ঘটনার আট মাস পর ইমদুকে আসামি করে আজিজের ভাই মজিদ বাদী হয়ে কালীগঞ্জ থানায় মামলা করেন। খুনের মামলা করায় ইমদু ভীষণ ক্ষিপ্ত হয় মজিদের ওপর। ১৯৮১ সালের ১৮ মার্চ মজিদ কালীগঞ্জ থানার সুকুন্দিয়া গ্রামে তার বোন আয়াত বানুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে ইমদুর বাহিনী আয়াত বানুর বাড়ি ঘেরাও করে। মজিদকে ঘুম থেকে তুলে হত্যা করে। পরে মজিদের আরেক ভাই হাকিমকেও ইমদু বাহিনী নৃশংসভাবে খুন করে। একটা সময় বন্ধু আলী হোসেনের সঙ্গে ইমদুর শত্রুতা তৈরি হয়। শোনা যায়, আলী হোসেনের সঙ্গে তার বিরোধটা তৈরি হয় বিএনপিতে যোগ দেওয়া না দেওয়া নিয়ে। আলী হোসেন নৃশংসভাবে খুন হন ঢাকার তেজকুনিপাড়ায়। আলী হোসেনের সহযোগী দুর্বাটি গ্রামের চানু ভূঁইয়াকেও গুলি করে হত্যা করে ইমদু। একই এলাকায় রশীদ নামে আরেকজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।’
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সফিক উল্লাহ এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনি তাঁর পুলিশ জীবনের স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন বই, ‘এক পুলিশের ডায়েরি’। সেখানে তিনি বলেছেন যে ইমদুকে ধরার দায়িত্ব আসলে তাঁরই ছিল। তখন তিনি ঢাকায় বদলি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের পদ, দায়িত্ব শিল্প এলাকা। ঢাকার পুলিশ সুপার ছিলেন মাহমুদ আল ফরিদ। সফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘মানিকগঞ্জ এবং নরসিংদীতে সর্বহারা-গণবাহিনী দমন করার অভিজ্ঞতার কারণে এসপি মাহমুদ আল ফরিদ আমাকে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে ইমদুকে ধরার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। কয়েকবারই তাকে ধরার জন্য অভিযান চালিয়েছিলাম। কিন্তু তখন সফল হইনি। ইমদুকে অবশ্য পরে ধরা সম্ভব হয়েছিল। তাকে ধরার পুরো পরিকল্পনাটাই ছিল আমার। তবে সেটা আরও কিছুদিন পরের কথা। যুবদলের সভাপতি তখন যুববিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেম। ইমদু ছিল আবুল কাশেমের একেবারে খাস লোক। বিষয়টি সবাই জানত। সে নিজেও তা প্রচার করত। সে কারণে যুবদলের পল্টন অফিসে ইমদুর তখন ভীষণ প্রতাপ। এ রকম অবস্থায়ও পুলিশ সুপারের নির্দেশে নানা পরিকল্পনা নিয়ে ইমদুকে ধরার তৎপরতা চালাতে থাকি। যাহোক, ইমদুকে পাকড়াও করার প্রচেষ্টা আমার একদিন ঠিকই সফল হলো। সেই ঘটনা অনেকটা হিন্দি ফিল্মের মতো।’
সফিক উল্লাহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, সেদিন ছিল সোমবার। খবর পাই ইমদু পল্টনে যুবদল অফিসে যাবে। সে অনুযায়ী সুবেদার খালেকের নেতৃত্বে টিমকে দ্রুত আমার আজিমপুরের বাসায় ডেকে আনি। কীভাবে অপারেশন পরিচালনা করবে এবং ইমদুকে কীভাবে গ্রেপ্তার করবে, তাদের সে বিষয়ে নির্দেশনা দিই। কিন্তু তারা পথে থাকতেই খবর পাই ইমদু আজ যুবদল অফিসে যাবে না, ৪০ মিন্টো রোডে যুব প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাড়িতে থাকবে। কিছুক্ষণ পর খবর পাই এখন সে আছে মন্ত্রী কাশেমের বাড়িতে। আমার সোর্সের কাছ থেকে এসব খবরই আমি পাই টেলিফোনে। তখনই ওয়্যারলেসে খালেককে পরিবর্তিত পরিকল্পনার বিষয়টি জানাই। সুবেদার খালেকের নেতৃত্বে টিমটিকে পাঠিয়ে আমি চলে যাই মিলব্যারাক পুলিশ লাইনে। মিলব্যারাকে গেলেও পুরো সময় খালেকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হচ্ছিল ওয়্যারলেসে। প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে আমি তাকে নির্দেশনা দিচ্ছিলাম।’
এরপর সফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের পাশের বাড়িটিই ছিল ঢাকার ডিসি মোফাজ্জল করিমের সরকারি বাসা। কিছুক্ষণ পর সুবেদার খালেক ডিসি মোফাজ্জল করিমের বাসার টেলিফোন থেকে আমাকে জানায়, ইমদু মন্ত্রীর বাসা থেকে রাস্তার কাছাকাছি এসেই আবার ভেতরে চলে গেছে। আমি তাকে ওই বাড়ির চারদিকে একটু দূরে ফোর্স মোতায়েন করে এমন অবস্থায় থাকতে বলি যেন কোনো দিক দিয়েই পালাতে না পারে। ওই বাড়ির পেছনে ছিল জাস্টিস মোস্তফা কামালের বাড়ি। সেখানেও পুলিশের লোক রাখা হয়, যাতে দেয়াল টপকিয়ে জজ সাহেবের বাসার ভেতরে ঢুকে পড়তে না পারে।
ডিসি মোফাজ্জল করিম এ সময় কয়েকবার আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং যেকোনো অবস্থাতেই ইমদুকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে বলেন। তিনি পুলিশ সুপার মাহমুদ আল ফরিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর তাঁকে পেয়ে পুরো ঘটনা জানাই। উনি কিছুটা বিচলিত বোধ করছিলেন। বিষয়টি নিয়ে ডিসি মোফাজ্জল করিমের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। মোফাজ্জল করিমের দৃঢ়তা এবং আমার পুরো কার্যক্রম দেখে তিনি পুলিশ সদর দপ্তর থেকেই আইজিপি, স্বরাষ্ট্রসচিব ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. মতিন কথা বলেন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে, তারপর নির্দেশ দেন যেভাবেই হোক ইমদুকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
এর পরপরই মাহমুদ আল ফরিদ স্বয়ং চলে যান মিন্টো রোডের ডিসি মোফাজ্জল করিমের বাসায়। সেটাকে অনেকটা কন্ট্রোল রুমের মতো বানিয়ে ইমদুকে ধরার দৃঢ় অবস্থান নেন। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিমন্ত্রী কাশেম সাহেব কথা বলেন প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. মতিন ও পরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে। কোথাও সহায়তা পেলেন না তিনি। অগত্যা ইমদুকে বাড়িতে রেখে তিনি মন্ত্রণালয়ে চলে যান। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইমদুকে তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে পুলিশের নিকট আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেম। ইমদু প্রতিমন্ত্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার খালেকের নেতৃত্বে পুলিশ ফোর্স তাকে গ্রেপ্তার করে।’
তখন ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম। তিনিও ইমদুকে ধরার অভিজ্ঞতা লিখেছেন। ‘মনে পড়ে মেলবোর্ন ভুলিনি তো ঢাকা’ নামের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘সকাল ন’টা বাজতে একটু বাকি। আমি বাসার অফিস রুমে একা একা বসে কাজ করছি। এমন সময় আমার দেহরক্ষী হাবিলদার কাদের ঘরে ঢুকে সালাম ঠুকে দাঁড়াল। একটুখানি ঝুঁকে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, স্যার, ইমদুকে ফলো করার জন্য যাকে ডিউটি দেওয়া হয়েছে, সেই খালেক হাবিলদার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কী নাকি খুব জরুরি খবর আছে।’ এরপর খালেক পকেট থেকে তার সচিত্র আইডি কার্ড বের করে দেখিয়ে প্রথমেই বলল, স্যার, এই মুহূর্তে আপনি ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
তারপর খালেক যা বলল তা সংক্ষেপে এই, গাজীপুর মহকুমার কালীগঞ্জ থানার কুখ্যাত সন্ত্রাসী, সাতটি খুনের মামলাসহ অনেক জঘন্য অপরাধের মামলার আসামি ইমদাদুল হক ওরফে ইমদুকে ফলো করার জন্য আদেশ পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাকে সে ছায়ার মতো অনুসরণ করে আসছে। আজ ঢাকা শহরের এক জনাকীর্ণ এলাকায় ইমদুকে হঠাৎ একা দেখে চমকে ওঠে খালেক। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধের ব্যাগ থেকে ওয়্যারলেস সেট বের করে নিকটবর্তী থানা থেকে রিএনফোর্সমেন্ট চায় সে। অল্প কিছু সশস্ত্র সেপাই আসতে আসতে ইমদু বোধ হয় বাতাসে গন্ধ পেয়ে মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যায়। তারপর খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ তাকে মিন্টো রোডের কাছে আবিষ্কার করে খালেক। এদিকে ইমদুও দেখে ফেলে তাকে। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে ইমদু গিয়ে ঢুকে পড়ে অভিজাত মিন্টো রোড এলাকার এক বাড়িতে। ঢুকেই ওই বাড়ির প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয় ভেতর থেকে।’
এরপর মোফাজ্জল করিম বইটিতে পুলিশের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগের বর্ণনা দিয়েছেন। তেমন কারও সাড়াই পাচ্ছিলেন না। তারপর লিখেছেন, ‘এমন সময় দেখি এসপি ফরিদের গাড়ি এসে থামল বারান্দার নিচে। তাকে কেবল সবকিছু খুলে বলতে শুরু করেছি, এমন সময় ওপর থেকে বাবুর্চি ফারুক দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে নেমে এসে জানাল, ওপরে বেডরুমে লাল টেলিফোন বাজছে অনেকক্ষণ ধরে। ধরতেই শুনি অপর প্রান্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. আব্দুল মতিনের গলা। তিনি খুব শান্ত কণ্ঠে জানালেন, তাঁর কাছে খবর এসেছে, একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী পুলিশের তাড়া খেয়ে মন্ত্রী কাশেম সাহেবের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। আর আমার কাছে সাহায্য চাইতে গেছে সাদাপোশাকের একজন হাবিলদার। আমি কী ব্যবস্থা নিয়েছি এবং এখন পরিস্থিতি কী জানতে চাইলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি তাঁকে সবই বললাম আমার ব্যর্থ প্রচেষ্টাসহ। শুনে মন্ত্রী মহোদয় বললেন, এত বড় একটা খুনি সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করার দায়িত্ব আমি আপনাকে দিচ্ছি। এক্ষুনি ডিএমপির ফোর্স রিপোর্ট করবে আপনার কাছে। প্রয়োজনবোধে মন্ত্রীর বাড়ির দরজা ভেঙে, গুলি চালিয়ে আসামিকে জীবিত অথবা মৃত আটক করবেন আপনি। এরপর তিনি জুড়ে দিলেন আরেকটি বাক্য, প্রেসিডেন্ট সাহেবের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তিনিই এই নির্দেশ দিয়েছেন।’
তারপরে পুরো পরিবেশের নানা ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন মোফাজ্জল করিম। তারপর লিখেছেন, ‘একটু পরে দেখি মন্ত্রী আবুল কাশেম মার মার কাট কাট করতে করতে ফিরে এসেছেন অফিস থেকে। তাঁর মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব, প্রাক্তন সিএসপি আসফউদ্দৌলাহও এসেছেন তাঁর সঙ্গে। তাঁরা সবাই ছোট্ট অফিস রুমে বসে আছেন, আর মন্ত্রী সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে এই পুলিশি অভিযানের তীব্র সমালোচনা করছেন।
আমি মন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ করলাম রুমের বাইরে এসে আমার সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলতে। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম কেন আসামিকে গ্রেপ্তার না করে আমাদের পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পর্যায়ে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে তা–ও বললাম। সুতরাং ওই ছোকরাকে বলেকয়ে আত্মসমর্পণ করিয়ে দেওয়াটাই ওই মুহূর্তে সব দিক থেকে মঙ্গলজনক হবে—বললাম আমি। এমন সময় হঠাৎ এক লোক ছুটে এল আমাদের কাছে। সে মন্ত্রীকে বলল, আর্মি চিফ এরশাদ সাহেব কথা বলতে চান। শুনেই মন্ত্রীর মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। মন্ত্রী কাশেম সাহেব প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন ওখান থেকে। মিনিট দশেক পর ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। অনেকটা বিয়েবাড়িতে পাত্রীকে কবুল পড়ানোর জন্য কনেপক্ষ যেমন আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যায় বরপক্ষকে, তেমনি আমাদের প্রতি আহ্বান জানালেন তিনি, আসুন ডিসি সাহেব, আসুন আপনারা। কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশসহ ঢুকলাম সে ঘরে। দেখি আগাপাছতলা সাদা চাদরে মোড়া, প্রায় পাঁচ ফুট ন’দশ ইঞ্চি লম্বা, শ্যামবর্ণ, ছিপছিপে এক যুবক ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে করজোড়ে। ইমদুর চেহারায় দ্রোহ বা জিঘাংসার চিহ্নমাত্র নেই, বরং একটা বিগলিত ভাব, ভীতি ও ক্ষমাপ্রার্থনার প্রগাঢ় আকুতি।’
সফিক উল্লাহ অবশ্য লিখেছেন যে মোফাজ্জল করিম বইয়ে ইমদুকে আটকের সব কৃতিত্ব নিজে নিলেও প্রকৃত ঘটনা তা নয়। বরং তিনি নিজেকেই বেশি কৃতিত্ব দিয়েছেন। অবশ্য আটক করার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা প্রায় একই রকম। তবে ঘটনার পেছনে কিছু আছে কি না, সেটাই সবার প্রশ্ন। আর এই সন্দেহের কথা মোফাজ্জল করিম নিজেই বইয়ে লিখেছেন। তিনি একই বছরের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারির কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘জাতির উদ্দেশে রেডিও-টিভিতে ভাষণ দিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁর ভাষায়, দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল দেশ, এর জন্য নাকি দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ করা ছাড়া উপায় ছিল না।
রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার উল্লেখ করতে গিয়ে মাস দেড়েক আগে এক মন্ত্রীর বাড়ি থেকে একজন দুর্ধর্ষ খুনি আসামি গ্রেপ্তারের কথাও উল্লেখ করলেন এরশাদ সাহেব। টিভি-ভাষণে কথাটা শুনেই কেমন খটকা লাগল আমার। ইংরেজিতে যাকে বলে স্মেলিং র্যাট, তেমনি একটা অনুভূতি হলো আমার। সাত খুনের আসামি ইমদু শেষটায় ধরা পড়ল কোথায়? মন্ত্রী কাশেম সাহেবের বাসায়, যে বাসায় উপমন্ত্রী বা তাঁর পরিবার-পরিজন কেউ তখন ছিলেন না; কাশেম সাহেব ছিলেন অফিসে, আর তাঁর স্ত্রী-পুত্রকন্যা সবাই আগেই বেড়াতে গিয়েছিলেন কুমিল্লায়, দেশের বাড়িতে। এর আগে পুলিশ কিন্তু ইমদুকে রাস্তাঘাটে দেখার পরও পাকড়াও করেনি।
সেদিনও ইমদু যখন পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সটকে পড়ার চেষ্টা করতে করতে একপর্যায়ে উপমন্ত্রীর প্রায় শূন্য বাড়িতে ঢুকে পড়ে একটা ঘরের ভেতর নিজেকে অর্গলাবদ্ধ করল, তখনই বৃদ্ধি পেল পুলিশ তৎপরতা। দীর্ঘদিন ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হলো না। অবশেষে একদিন হাতি ধরার ফাঁদের ভেতর শিকারিরা যেমন বুনো হাতির পালকে খেদিয়ে খেদিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি আসামিকে নিয়ে যাওয়া হলো উপমন্ত্রীর বাড়িতে। তারপর ওই নাটকের শেষ দৃশ্যে আচমকা সেনাপ্রধানের টেলিফোন উপমন্ত্রীকে। এখন মনে হয়, পুরো ব্যাপারটা ছিল কেমন যেন সাজানো-গোছানো একটি চিত্রনাট্যের মতো। ওই ঘটনা ঘটে ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ, আর এরশাদ সাহেব মার্শাল ল-র হুংকার দিয়ে তখতে বসেন মার্চের ২৪ তারিখ—গুনে গুনে দেড় মাস পর।’
২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় ইমদুর ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন,
‘সীমাহীন দুর্নীতির ফলে দেশে এমন এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তাহার সরকারি বাসভবনে একজন ঘৃণ্য খুনি আসামিকে আশ্রয়দান করিতে দ্বিধাবোধ করে নাই। আপনারা জানিয়া বিস্মিত হইবেন যে, এই ন্যক্কারজনক ঘটনা যাহাতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয়, সে জন্য সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ সেদিন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু আমাদের নির্ভীক-সত্যনিষ্ঠ, সাংবাদিকগণ সেই কুচক্রী মহলের কাছে নতি স্বীকার না করিয়া সাংবাদিকতার মহান আদর্শ সমুন্নত রাখিতে সমর্থ হন। যাহার ফলে এই দুর্নীতিবাজ সরকারের মুখোশ খুলিয়া পড়ে জনগণের সম্মুখে এবং তাহারই ফলশ্রুতিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার বাধ্য হন।’
এরশাদের সামরিক শাসনামলেই মার্শাল ল কোর্টে বিচার হয় ইমদুর। সামরিক আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি খুনের মামলা উত্থাপিত হয়। দুটি মামলায় ইমদু ও তাঁর তিন সঙ্গীর ফাঁসির আদেশ হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ইমদুর ফাঁসি কার্যকর হয় ১৯৮২ সালের ৪ আগস্ট।
এর আগে ইমদুর নৃশংসতা নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ‘যদি কিছু মনে না করেন’ তখন টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের একটি। উপস্থাপক ফজলে লোহানী কালীগঞ্জে গিয়ে ইমদুর কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুষ্ঠান করেন। সামরিক শাসন জারির আগের দিন ফজলে লোহানী এবং দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবেও পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমদও। তিনি অনেক কিছুই কাছ থেকে দেখেছেন। ‘চলমান ইতিহাস’ বইয়ে তিনি ইমদু আটকের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, ‘সাত্তারের মন্ত্রিসভার দুটি গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করে। জামালউদ্দিন আর হাসনাতকে টার্গেট করা হলো—দেশের মধ্যে যেন শুধু তারাই দুর্নীতিবাজ। একই চক্রান্তের ফলে আবুল কাশেমের বাড়ি থেকে খুনের আসামি ইমদাদুল হক ইমদুকে পাওয়া গেল। সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করাই হলো মূল লক্ষ্য। একজন পলাতক আসামিকে ধরার জন্য এক মন্ত্রীর বাড়িতে একই মন্ত্রিসভার আরেকজন মন্ত্রী ঢাকঢোল পিটিয়ে পুলিশ পাঠান। সে এক অসম্ভব কাণ্ড। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিনের সঙ্গে কাশেমের মনোমালিন্য ছিল, তাই তার প্রতিশোধ নেওয়া হলো এইভাবে। দেশের বা দলের বা সরকারের স্বার্থটা একবারও ভেবে দেখা হলো না। লোকশ্রুতি অনুযায়ী মতিন ছিলেন শাহ আজিজের গ্রুপের সদস্য, আর কাশেম ছিলেন জামালউদ্দিন-হাসনাত গ্রুপের।
ইমদুর ঘটনা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো হয়। রং চড়িয়ে একে একটি রীতিমতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। সরকারবিরোধী এবং সামরিক বাহিনীর সমর্থক শক্তিগুলো এ ঘটনাকে আরও নাটকীয় করার চেষ্টা করে। ঘটনাটি সরকারের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং অক্ষমতাকে আরও প্রকটভাবে জনসাধারণের সামনে উপস্থাপিত করে। যেকোনো কারণের জন্য হোক বা যে ষড়যন্ত্রের জন্যই হোক, ব্যাপারটিকে ফলাও করে প্রচার করার ফলে জনসমক্ষে সরকার হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং সুনামহানি ঘটে। এ ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসাররা যেন এ রকমই একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এই ঘটনায় দেশ পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ভূমিকার প্রয়োজনটা যেন আরও প্রকট আকার ধারণ করল। ঘটনাটি একটি রহস্যে ঢাকা থাকে। অনেকের মতে ইমদুকে কাশেমের বাড়িতে একটি বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগের পরামর্শে প্ল্যান্ট করা হয়েছিল এবং পুরো ব্যাপারটি ছিল একটি ষড়যন্ত্রমূলক সাজানো ঘটনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না বুঝে শুধু কাশেমের ওপর তার ক্ষোভ মেটানোর জন্য ও ধরনের একটি কাজে জড়ায়নি।’
মওদুদ আহমদ সবশেষে লিখেছেন, ‘ইমদু এবং কাশেমের ঘটনার পর ১১ ফেব্রুয়ারি কিছু সিনিয়র সেনা অফিসার দুপুর দুটোর দিকে বঙ্গভবনে যান। তাঁরা প্রেসিডেন্টের কাছে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং প্রেসিডেন্ট যাতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন, সে জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে তাঁরা সেদিন বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন এবং যতটুকু চাপ সৃষ্টি করার দরকার তা করেছিলেন। তাঁরা প্রেসিডেন্টকে প্রথমে অনুরোধ এবং পরে বেশ রূঢ় ভাষায় ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত সাত্তার তাঁর “অদক্ষ এবং দুর্নীতিপরায়ণ” মন্ত্রিসভা বাতিল করতে রাজি হলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হননি। সামরিক অফিসাররা একটি মিশ্র মনোভাব নিয়ে ব্যারাকে ফিরে যান।’
সেদিন ফিরে গেলেও এর কিছুদিন পরে ঠিকই সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। ফলে ইমদু আটকের সঙ্গে সামরিক শাসন জারির একটা সম্পর্ক ইতিহাসে ঠিকই থেকে যাবে।
প্রথম প্রকাশ, ২৪ মার্চ, ২০২৩