নির্বাচন যতই কাছাকাছি আসছে, জি এম কাদের ও রওশন এরশাদকে ঘিরে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) অভ্যন্তরীণ বিরোধ ততই দানা বাঁধছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাপার ভেতরকার এই বিরোধ মূলত দলটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই বিরোধের অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দলের বাইরে থেকে। ফলে এই বিরোধ নিরসনের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন দলটির নেতাদের অনেকে।
জাপার গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, দলের কর্তৃত্ব, কমিটি গঠন ও প্রার্থিতা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ সামনে আরও প্রকাশ্য হতে পারে। নেতা-কর্মীদের বড় অংশটি এখন পর্যন্ত দলীয় চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকলেও একটা পক্ষ নির্বাচন সামনে রেখে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে ঘিরে তৎপর রয়েছেন। আবার অনেকে দুই দিকেই সম্পর্ক রেখে চলছেন।
জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে কী করবে, সেটা এখনো বলার সময় হয়নি।কাজী ফিরোজ রশীদ, কো-চেয়ারম্যান, জাপা
জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অনেকের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকতেই দলে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভক্তি যেভাবে জিইয়ে ছিল, সেটা আগামীতেও থাকবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় জি এম কাদের কোনো কারণে সরকারবিরোধী অবস্থান নিলে, রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশ পাল্টা অবস্থান নেবে। আর এ ক্ষেত্রে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ যে সরকারের সঙ্গেই থাকবেন, তা তিনি বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যে বলেছেন।
দলটির নেতাদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ওই দুটি নির্বাচনে জাপাকে অংশ নিতে হয়েছিল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ না নেয়, সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে জাপার গুরুত্ব বেড়ে যাবে।
জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হোক, তা কোনো সরকারই চায় না। কারণ, জাতীয় পার্টি দুর্বল হলেই তাদের লাভ। কিন্তু যারা নিজ দলকে দুর্বল করতে চক্রান্তের অংশ হচ্ছে, তারা না বুঝে করছে। শেষ পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব থাকবে না।জি এম কাদের
সে সম্ভাবনা সামনে রেখে জাপার সাবেক ও বর্তমান নেতাদের অনেকে সংসদ সদস্য হওয়ার আশায় এখন থেকেই রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখছেন। কারণ, সরকারের কাছে জি এম কাদেরের চেয়ে রওশন এরশাদ বেশি আস্থাভাজন বলে জাপার নেতাদের অনেকের ধারণা। সম্প্রতি দল পরিচালনা নিয়ে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের যে পরিস্থিতির মধ্য পড়েছিলেন, তাতে দলের নেতাদের এই ধারণা আরও জোরদার হয়েছে।
জি এম কাদেরের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত হওয়ার পর তাঁর দল পরিচালনায় এখন সমস্যা না থাকলেও দলের ভেতরকার সংকট কাটেনি।
যদিও জাপার অন্যতম কো–চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জাতীয় পার্টিতে কোনো দ্বন্দ্ব দেখেন না। তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে হয়তো কথা আছে, সেটা দলে ভাঙন সৃষ্টি করতে পারবে না। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে কী করবে, সেটা এখনো বলার সময় হয়নি। তবে জাতীয় পার্টি যা–ই করবে, সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে।
জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রওশনপন্থী অংশটি কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর এখন নতুন করে জাপার সম্মেলন অনুষ্ঠানে তোড়জোড় শুরু করেছে। তারা ২৩ এপ্রিল সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির একটি সভা করে। ওই সভায় রওশনপুত্র ও দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ প্রধান অতিথি ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে আগামী জুনের মধ্যে সম্মেলন করে কমিটি গঠন এবং সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের খসড়া তালিকা করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে রওশনপন্থীরা ৪২টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করেছে। যদিও এসব কমিটির অধিকাংশ সদস্যই দলছুট বা বহিষ্কৃত নেতা। আবার দীর্ঘদিন রাজনীতিতে ছিলেন না, এমন সাবেক নেতাদেরও কমিটি রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ ২৭ এপ্রিল মানিকগঞ্জে জাপার এক নেতার মতবিনিময় সভায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন রওশন এরশাদ। সেখানে তিনি বলেন, ‘যোগ্যতার মূল্যায়নে আগামীতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে।’
জেলা কমিটি করার ঘোষণাসহ এসব তৎপরতার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে রওশনপন্থীদের দলীয় পদ ঢোকানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে করছেন জি এম কাদেরের অনুসারীরা।
জাপার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি রওশন এরশাদ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে ২৪ জন নেতার একটি তালিকা পাঠিয়ে তাঁদের দলীয় পদে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। তাঁদের মধ্যে রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া জিয়াউল হক মৃধা, মসিউর রহমান ও কাজী মামুনুর রশীদও রয়েছেন।
এ বিষয়ে জাপার একজন কো–চেয়ারম্যান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ যাঁদের নাম পাঠিয়েছেন, তাঁরা দলে কোনো না কোনোভাবে অভিযুক্ত। দলীয় চেয়ারম্যান যদি নিজ ক্ষমতাবলে তাঁদের দলে নেনও, তাঁকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও দলের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা গত ৩০ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় আদালত দলীয় কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন থেকে জি এম কাদেরকে বিরত রাখতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। প্রায় তিন মাস তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত ছিলেন।
পরে উচ্চ আদালত নিষেধাজ্ঞার ওই আদেশ স্থগিত করলে তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তবে এখনো নানামুখী চাপের মধ্যে আছেন বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। এর মধ্যে রওশনপন্থীরা জাতীয় পার্টির প্যাড ও ঠিকানা ব্যবহার করে দলের নামে বিবৃতি-বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন সিদ্ধান্তও জানাচ্ছে।
জাপার এই বিভক্তিকে ‘মহল বিশেষের আরোপিত’ বলে মন্তব্য করেন জি এম কাদের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হোক, তা কোনো সরকারই চায় না। কারণ, জাতীয় পার্টি দুর্বল হলেই তাদের লাভ। কিন্তু যারা নিজ দলকে দুর্বল করতে চক্রান্তের অংশ হচ্ছে, তারা না বুঝে করছে। শেষ পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব থাকবে না।