শরিকদের সঙ্গে এখনো কোনো আলোচনা করেনি আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে নির্বাচনের প্রশ্নে অনিশ্চয়তায় শরিক ও মিত্ররা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জোটবদ্ধভাবে অংশ নেবে নাকি একলা লড়তে হবে, এ বিষয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছে আওয়ামী লীগের শরিক ও মিত্ররা। ক্ষমতাসীন দলটি ২৯৮ আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। কিন্তু এখনো ১৪-দলীয় জোট ও মিত্রদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। ফলে শরিকেরা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পাবে কীনা, এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, অনানুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দলের শরিকদের বার্তা দেওয়া হয়েছে যে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে হবে। এরপর সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু শরিকেরা আগে সমঝোতার বিষয়ে জোর দিচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু শরিক দলের নেতা নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন। কেউ কেউ সমঝোতার আশ্বাস পেলে জমা দেবেন বলে অপেক্ষায় আছেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, এবার জোট ও মিত্রদের চাওয়া প্রায় ২০০ আসন। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আওয়ামী লীগ জানতে পেরেছে অন্তত ৮০ আসনে ছাড় দিতে হবে। জাপা বাদে অন্য সঙ্গী ও মিত্রদের বেশির ভাগ নৌকা প্রতীকে ভোট করতে চায়।
গত রোববার আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে কাউকে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, কুষ্টিয়া-২ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু আগেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ জন্য তাঁর আসনে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির প্রার্থী হলেও তাঁকে আওয়ামী লীগ ‘ঘরের’ ছেলে মনে করে। প্রয়োজন হলে তাঁকে নৌকা দেওয়া হতে পারে।
জাতীয় পার্টিও (জাপা) ২০০৮ সালের পর প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একধরনের সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। দলটি গতকাল ২৮৭ আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে এবার এখনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার গণভবনে মতবিনিময় সভায় দলের সব মনোনয়ন প্রত্যাশীর উদ্দেশে দুটি বার্তা দিয়েছেন। প্রথমত, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা যাবে না। দ্বিতীয়ত, স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাপ দেওয়া যাবে না। এরপর গতকাল সোমবার সারা দেশে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
জোটগতভাবেই নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছিল। আশা করি, শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের বৈঠক হবে।হাসানুল হক ইনু, সভাপতি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল
এদিকে জোটগতভাবে নির্বাচনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গী খোঁজার কোনো দরকার নেই। নতুন নতুন সময়ে নতুন নতুন কৌশলও দলকে গ্রহণ করতে হয়। এ সময়ে যে কৌশল দরকার, নেত্রী সে কৌশল ঠিক করেছেন।’
১৪ দলের শরিক ও আওয়ামী লীগের মিত্রদের সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া জাপার প্রার্থীদের জেতা কঠিন। ১৪ দলের শরিকেরা নৌকা প্রতীক না পেলে জিততে পারবেন না। কেউ কেউ মনে করছেন, আগের চেয়ে কম আসনে শরিকদের সন্তুষ্ট রাখতে কৌশলী চাপ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
জানতে চাইলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর জোটগতভাবে ভোটের বিষয়ে আলোচনা হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতারা নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জোটগত নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। তিনি যদি বলেন জোট হবে না, তাহলে ওয়ার্কার্স পার্টি আলাদা নির্বাচন করবে।
গত ২০ জুলাই সর্বশেষ ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর তাঁর সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি।
এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৬টি দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে জাপা, ১৪ দলের শরিক, ইসলামপন্থী কয়েকটি দল, সাম্প্রতিক নিবন্ধন পাওয়া ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত দলগুলোও রয়েছে। এসব দলের প্রায় সবাই সমঝোতার মাধ্যমে ভোট করতে চায়।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, এবার জোট ও মিত্রদের চাওয়া প্রায় ২০০ আসন। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আওয়ামী লীগ জানতে পেরেছে অন্তত ৮০ আসনে ছাড় দিতে হবে। জাপা বাদে অন্য সঙ্গী ও মিত্রদের বেশির ভাগ নৌকা প্রতীকে ভোট করতে চায়। জোট যদি করতেই হয় তাহলে শরিক-মিত্রদের ৩০ আসনের বেশি ছাড়তে রাজি নয় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আসন সমঝোতা হলে ভোটার উপস্থিতি ও অংশগ্রহণকারী কমে যাবে। তাই জোট চান না আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা।
এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। আমাদের চাওয়া সুষ্ঠু ভোট।মুজিবুল হক, মহাসচিব, জাতীয় পার্টি
বর্তমান সংসদে ১৪ দলের শরিকদের আসন আটটি। এবার আওয়ামী লীগ চার-পাঁচটির বেশি আসনে ছাড় দিতে রাজি নয়। ১৪ দলের অন্যতম নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ঢাকা-৮ আসন থেকে তিনবারের সংসদ সদস্য। এবার এই আসনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সূত্র বলছে, নাছিমের মতো কেন্দ্রীয় নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ায় এই আসন আওয়ামী লীগ ছাড়বে কি না, এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নৌকা প্রতীক না পেলে রাশেদ খান মেনন এই আসন থেকে ভোট করবেন না, এমনও মত আছে দলটিতে। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার রাজশাহীর আসনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ফেনী-১ আসনে দুইবারের সংসদ সদস্য। এবার আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক নির্বাহী সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। ফলে শিরীন আখতারের ঘনিষ্ঠজনেরা এই আসনে সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। জাতীয় পার্টির (জেপি) একমাত্র সংসদ সদস্য দলটির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তাঁর পিরোজপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে।
জোট যদি করতেই হয় তাহলে শরিক-মিত্রদের ৩০ আসনের বেশি ছাড়তে রাজি নয় আওয়ামী লীগ।
চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে টানা তিনবার সংসদ সদস্য তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। এবার এই আসনে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ নির্বাচন করতে চাইছেন। তিনি সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া সুপ্রিম পার্টির প্রধান। আওয়ামী লীগ সেখানে খাদিজাতুল আনোয়ারকে মনোনয়ন দিয়েছে।
নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী জোটের কথা বলেছেন। এখন জোটগতভাবে ভোট না হলে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই তাঁরা শুনতে চান।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া চট্টগ্রাম-১ আসন চাইছেন। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। সেখানে তাঁর ছেলে মাহবুব উর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
তবে জোটের সম্ভাবনা নিয়ে ইতিবাচক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও জোটের শরিকেরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে। জোটগতভাবেই নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছিল।’ তাঁর আশা, শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের বৈঠক হবে।
বর্তমান সংসদে জাপার সংসদ সদস্য ২৩ জন। আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, বিভিন্ন মাধ্যমে জাপা জানিয়েছে এবার তাদের কমপক্ষে ৪০টি আসন দিতে হবে। অন্যান্য আসনে উম্মুক্ত প্রতিযোগিতা করবে দলটি। তবে আওয়ামী লীগ চাইছে জাপা আলাদা নির্বাচন করুক। তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আসনে আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত ‘দুর্বল’ প্রার্থী দিয়ে সহায়তা করবে। কিন্তু এখনো সেই সমঝোতা হয়নি।
জানতে চাইলে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে নেমেছি। এখন সমঝোতা নয়, আমাদের চাওয়া সুষ্ঠু ভোট।’