স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলত তিনটি রূপ গ্রহণ করেছে। সামরিক শাসন, প্রতিযোগিতামূলক দল ব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী দল ব্যবস্থা। এখন চলছে কর্তৃত্ববাদী দলব্যবস্থা; এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অনির্বাচিত শাসকের শাসনব্যবস্থার মতো।
বাংলাদেশের ৫০ বছর নিয়ে একটি বইয়ে রাজনীতি নিয়ে আলাদা তিনটি গবেষণামূলক লেখায় এ কথা উঠে এসেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, রক্ষণশীল ইসলামপন্থী রাজনীতি ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে। গণতান্ত্রিক পরিসর আরও কমে এলে ক্ষমতাসীনদের নৈতিক বৈধতার জন্য ইসলামি শক্তির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও ইসলামপন্থী রাজনীতির মধ্যে বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা ক্ষেত্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আর আছে কি না, তা নিয়েও আলোচনা তৈরি হয়েছে।
‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ: ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক এই বই সম্পাদনা করেছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান ও সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কার্যালয়ে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
এই বইয়ে বাংলাদেশের ৫০ বছরের রাজনীতি নিয়ে তিনটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যন্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. মির্জা হাসান, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক আরিল্ড এঙ্গেলসেন রূড। এই তিন লেখার পর্যালোচনা (রিভিউ) করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
রওনক জাহানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মির্জা এম হাসান বলেন, তিনি মূলত গত ৫০ বছরে রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজের সম্পর্ক কতটা বিবর্তিত হয়েছে, সেটা দেখাতে চেয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তিনটি রূপ গ্রহণ করার কথা বলেন। এর মধ্যে আছে কর্তৃত্ববাদী দলের রাষ্ট্র, যেটা এখন চলছে। বাকি দুটি হলো সামরিক শাসন ও প্রতিযোগিতামূলক দল ব্যবস্থা। তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদী দলের রাষ্ট্রব্যবস্থা চলেছে ২৪ বছর। আর তথাকথিত প্রতিযোগিতামূলক দল ব্যবস্থা ছিল ১৭ বছর। তবে এই ব্যবস্থাও নির্বাচনের পরদিন থেকে আসলে কর্তৃত্ববাদী রূপ নেয়। সে হিসেবে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা হলো ৪৩ বছর। সরাসরি সামরিক শাসন ছিল ৯ বছর।
মির্জা হাসান বলেন, কর্তৃত্ববাদী দলের রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক এলিটরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যখন তাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তখন তাঁরা আবার গণতন্ত্রের কথা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। আবার ক্ষমতায় ফিরে কর্তৃত্ববাদী শাসনে চলে যান।
অনলাইনে আলোচনায় যুক্ত হয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির ধারা ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। এখানে ইসলামপন্থী রাজনীতির একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। হুট করে এটি তৈরি হয়েছে বা রাষ্ট্র তৈরি করেছে তা নয়। তবে এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের বাইরেও সমাজের মধ্যে সামাজিকভাবে বিভিন্ন রকম ধারা, সংগঠন কাজ করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে ইসলামপন্থীদের রক্ষণশীল অংশটি। এটা সামাজিকভাবেও হয়েছে, রাজনৈতিকভাবেও হয়েছে। ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হবে।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, এই তিনটি লেখা বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা বুঝতে সহায়তা করবে। মির্জা হাসান তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলত তিনটি রূপ গ্রহণ করেছে। কর্তৃত্ববাদী দলের রাষ্ট্র হিসেবে শাসনে রাজনৈতিক এলিটরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এতে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, সিভিল সোসাইটির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ সামাল দেওয়া সহজ হয়। কয়েক দশকে ব্যবসা–বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা কমেছে। ব্যবসা খাত এখন রাজনৈতিক এলিটদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সুবিধা পেতে আগ্রহী।
মির্জা হাসানের লেখা উদ্ধৃত করে মতিউর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা সম্মিলিত রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলে নীতিমালার গতিপথ নির্ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। বেসরকারি ব্যাংক ও পোশাক খাত দেখলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসবের ফলে পোশাকশিল্পের মালিকেরা একচেটিয়া সুবিধা পেয়ে চলেছেন। তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকমালিকদের লুটপাটের ফলে অনেকগুলো ব্যাংক ধ্বংসের মুখে। এগুলো ধ্বংস করতে সরকার প্রশাসন সহায়তা করছে। এগুলোকে এখন আবার সরকার উদ্যোগী হয়ে একীভূত করার নামে ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই দুই অংশের নেতারা সরকারি দলের নেতৃত্বে সংসদে ও মন্ত্রিসভায় স্থান পান। সেদিক থেকে তাঁরা এই রাষ্ট্রে অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী।
বইটিতে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন আলী রীয়াজ। এ প্রসঙ্গে পর্যালোচক মতিউর রহমান বলেন, আলী রীয়াজ তাঁর আলোচনায় বলেছেন, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি বহুমুখী। তাঁদের কেউ কেউ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে চান। কেউ কেউ সামাজিকভাবে ইসলামীকরণের কৌশল গ্রহণ করেছেন। ফলে এই রাজনীতির সম্ভাবনা বুঝতে হলে সামাজিক ইসলামি সংগঠনগুলোর প্রয়াসগুলোর দিকেও তাকাতে হবে।
মতিউর রহমান বলেন, আলী রীয়াজের লেখায় এসেছে, ১৯৭৫ সালের পরে ইসলামিক রাজনীতিকে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। ২০১৩ সালের পর পৃষ্ঠপোষকতা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। সাধারণ সেক্যুলার দলগুলোও ইসলামীকরণে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল তাদের জোটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশি বেশি করে ইসলামিক দল ও গোষ্ঠীগুলোকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। দেশে ইসলামি রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন দল। গণতান্ত্রিক পরিসর আরও কমে এলে ক্ষমতাসীনদের নৈতিক বৈধতার জন্য ইসলামি শক্তির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন আরিল্ড এঙ্গেলসেন রূড। তাঁর লেখা উদ্ধৃত করে মতিউর রহমান বলেন, এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় পর্বের শুরু। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাবদল করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার আশা করতে পারত। শক্তিশালী কর্তৃত্ববাদী দলের সরকার এবং দল ২০১৪ সাল থেকে প্রভূত ক্ষমতা ও শক্তির প্রয়োগ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র, আইন-আদালতকে ব্যবহার করে এবং শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী দলকে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘কে বা কারা পথ দেখাবেন? রাজনৈতিক দল? তারা এক অর্থে পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়ে গেছে, উল্টো পথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।’
নিজের কলেজজীবনে ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকায় প্রথম ছাত্র ধর্মঘটের মিছিলে যোগ দেওয়ার স্মৃতিচারণ করে মতিউর রহমান বলেন, ‘সেদিনের সে ধর্মঘটের মিছিলে স্লোগান দিয়েছি, সামরিক শাসন চাই না। নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই, ভোটের অধিকার চাই। বাক্স্বাধীনতা চাই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই। তারপরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। ইতিমধ্যে ৬২ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আমরা সে দাবির কথা এখনো বলি। এখনো বলি—নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই, ভোটের অধিকার চাই, কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই।’