প্রতিবেশী দেশ ভারত পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক গুমের সহযোগী বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ে দুই দেশের সম্পর্কের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বন্ধু, প্রেম, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এত নিবিড় ছিল যে শেখ হাসিনার অনেক অপকর্মের দায় ভারত নিজে নিয়েছে। এ দায় নিতে গিয়ে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র শূন্য করার, বিরোধী দল শূন্য করার ক্ষেত্রে ভারতের যে দায় নেই, এটা অস্বীকার করা যাবে না। শেখ হাসিনার অনেক গুমের সহযোগী ভারত, এটা অস্বীকার করা যাবে না।’
আজ সোমবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত দোয়া মাহফিলে রুহুল কবির রিজভী এ কথা বলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু কার্যক্রমের প্রশংসা করে রিজভী বলেন, ‘এই গুম কমিশনের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্য পাচ্ছি। অনেক গুমের সহযোগী ছিল ভারত। আজকে অনেক লোককে ওখান (ভারত) থেকে ছাড়ছে। এখন এটা ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিত। এই যে লোকগুলো ছাড়ছে, তাহলে এরা কী গুম ছিল ভারতে! তাহলে নিশ্চয় ইলিয়াস আলী এখনো আছে, চৌধুরী আলম এখনো আছে, সাইফুল ইসলাম হিরু এখনো আছে। হুমায়ুন পারভেজ, জাকির, সুমন এখনো আছে। এটা তো একটা বিরাট ঘটনা।’
রিজভী বলেন, ‘কারণ, আপনারা যে এটা (গুম) করেছেন, শেখ হাসিনার গুমের সহযোগী যে আপনারা ছিলেন পার্শ্ববর্তী দেশ—তার প্রমাণ তো আমাদের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশে তিনি দুই মাস গুম থাকলেন, তার পর পাওয়া গেল ভারতে। বন্ধু, প্রেম, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এত নিবিড় ছিল যে শেখ হাসিনার অনেক অপকর্মের দায় ভারত নিজে নিয়েছে। শেখ হাসিনার অনেক গুমের সহযোগী ভারত, এটা অস্বীকার করা যাবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আপনাদের কাছে প্রত্যাশা ছিল (রাজধানী ঢাকা) একটা শান্তির শহর হবে। কেননা, এখন ছাত্রলীগ নেই, যুবলীগ নেই।’ তিনি বলেন, আজ চার মাস সাড়ে চার মাস হতে চলল। আজকে কেন ছিনতাইকারী বেড়ে যাবে। ছিনতাইকারীর ছুরিতে রাজধানীতে নয়জন মারা গেলেন কেন? কেন আজকে পাড়া-মহল্লায় চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে। তিন দিনের গণমাধ্যম দেখুন, চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে। তার মানে সরকারের সঙ্গে প্রশাসনের সমন্বয়টা ঠিকমতো হচ্ছে না।’
সমালোচনা করলে সরকারের দিক থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে—এমন ইঙ্গিত করেন রিজভী। তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টারা অনেক কিছু বলছেন, অনেক বড় বড় কথা বলছেন। আমরা যদি কিছু বলি আমাদের উল্টো সবক দিচ্ছেন যে আপনারা ৫৩-৫৪ বছরে কিছু করতে পারেননি। এখন আমরা করছি।’
এ প্রসঙ্গে সরকারের ভেতরে-বাইরের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘আরে বাবা, সারা পৃথিবীর অর্জন তো রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়েছে। আর যুদ্ধ তো হচ্ছে পলিটিক্যাল সংগ্রামের এক্সটেনশন। ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, এটাও তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এই অর্থে, একজন মেজর ঘোষণা দিয়েছেন, তার পর সরকার গঠন হয়েছে, তার পর তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর আপনারা সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়ে ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে অন্ধকারের মধ্যে সংস্কারের মাস্টারপ্ল্যানে করবেন, সেটা কী বিশ্বাসযোগ্য বিষয় হতে পারে?’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা, আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, আমাদের ’৯০ ’২৪—সবগুলোই তো হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। আপনারা হয়তো অনেকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু রাজপথে শার্টের বোতাম খুলে যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, যাঁরা হাসতে হাসতে পুলিশ–র্যাবের আয়নাঘরে গেছেন, যাঁদের দিনের পর দিন রিমান্ডে রেখেছেন, আপনারা তো সেই রিমান্ডে ছিলেন না। আপনারা তো সেই নির্যাতন ভোগ করেননি। সেটা তো আমাদের করতে হয়েছে। আর আপনারা বলছেন রাজনীতিবিদেরা এত দিন কিছু করতে পারেননি।’
এত দিন যা কিছু হয়েছে, সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, ‘এখন একটা ভিন্ন পরিস্থিতি। দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি। তারা যা করবে, সেটি নিশ্চিয় শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমের পুনরাবৃত্তি হবে না। আপনাদের ওপর বিশ্বাস রাখা হয়েছে। সেই বিশ্বাসটা আপনারা রক্ষা করবেন। তা না হলে আপনাদের প্রতিও মানুষ বিরূপ হবে।’
তবে সরকার একের পর এক যে কাজগুলো করছে, সেগুলো যে খারাপ হচ্ছে তা নয় বলে মন্তব্য করেন রিজভী। এ প্রসঙ্গে তিনি গুম কমিশনের তথ্যের কথা উল্লেখ করেন।
সংস্কার প্রসঙ্গে রিজভী এক ব্যক্তির একটি লেখা উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন, ‘এক ভদ্রলোক একটা সুন্দর কথা লিখেছেন। সংস্কার কোনো বিষয় না, একটা ছোট্ট ঘটনা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যে অন্যায় আদেশ দেবেন, সেই আদেশ যদি প্রশাসন না করে, সেটাই তো বড় সংস্কার। এই ‘না’ বলাটাই বড় সংস্কার, আর কোনো সংস্কার লাগবে না। অর্থাৎ আইনের শাসন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে এই পরিবেশটাই তৈরি করুন। যে পরিবেশে বিচারকেরা কোনো অন্যায় আদেশকে ‘না’ বলতে পারেন। এই একটা শব্দের মধ্যেই সব সংস্কার নিহিত আছে। যেটা শেখ হাসিনার আমলে সম্ভব হয়নি।’
মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানের সঞ্চালনায় দোয়া মাহফিলে বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ, মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক কর্নেল (অব.) জয়নুল আবেদীন, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী, কেন্দ্রীয় নেতা আহমেদ আলী মুকিত, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী প্রমুখ।