দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের চেয়ে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রদের মধ্যে কোটিপতি প্রার্থী বেশি।
আওয়ামী লীগের প্রায় ৮৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি। স্বতন্ত্রদের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৪৭ শতাংশ। এরপর জাতীয় পার্টির অবস্থান। তাদের প্রার্থীদের প্রায় ২২ শতাংশ কোটিপতি।
নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি কোটিপতির হিসাব করেছে নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, সোনাসহ বিভিন্ন অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে। জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পদ এই হিসাবে আসেনি।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল মঙ্গলবার ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শিরোনামের এই বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি টিআইবি সাধারণ মানুষের জন্য একটি ‘অনলাইন ড্যাশবোর্ড’ তৈরি করেছে, যার শিরোনাম ‘হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি’। টিআইবির ওয়েবসাইটে ড্যাশবোর্ডে প্রার্থীদের নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
টিআইবি এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া ১ হাজার ৯২০ জন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করেছে। তারা ১৬ ডিসেম্বর রাত থেকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হলফনামা ডাউনলোড শুরু করে। উল্লেখ্য, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৯৬ জনে দাঁড়িয়েছিল। পরে আদালতে গিয়ে কেউ কেউ প্রার্থিতা ফেরত পান। কারও কারও প্রার্থিতার বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন।
টিআইবি প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, আয়, সম্পদ, দায়, মামলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রবণতা বিশ্লেষণ করেছে। পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি আয় বৃদ্ধি, সবচেয়ে বেশি সম্পদ বৃদ্ধি, সবচেয়ে বেশি জমি ও সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত ১০ জন করে প্রার্থীর তালিকা তুলে ধরেছে।
হলফনামায় দেওয়া প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব পূর্ণাঙ্গ কি না, তা নিয়ে সংশয়ের কথাও তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, প্রার্থীর দেওয়া হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনেকটা দায়সারা গোছের। ঝুঁকিকে নিয়ন্ত্রণমূলক জায়গায় রেখে বাকি তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
টিআইবির বিশ্লেষণ বলছে, এবারের নির্বাচনে সব প্রার্থী, তাঁদের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রার্থীর স্বামী/স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা। প্রার্থীদের ৭২ শতাংশের অস্থাবর সম্পদ ১ কোটি টাকার নিচে। ১ থেকে ১০ কোটি টাকার সম্পদ আছে ২১ শতাংশের। বাকিদের সম্পদ এর চেয়ে বেশি। ১৮ জন প্রার্থীর সম্পদ ১০০ কোটি টাকার বেশি।
নির্বাচনে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ও হার বাড়ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৭৪ জন প্রার্থী ছিলেন কোটিপতি (১৭ শতাংশ)। সেটা বেড়ে এবার ৫৭১ জনে দাঁড়িয়েছে, যা মোট প্রার্থীর ২৭ শতাংশ।
আওয়ামী লীগে কোটিপতি প্রার্থী বেশি বেড়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন মোট প্রার্থীর প্রায় ২৮ শতাংশ, যা বেড়ে এখন ৮৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে চিত্রটি উল্টো। ২০০৮ সালে তাদের প্রার্থীদের ৩৬ শতাংশ ছিলেন কোটিপতি, যা এবার দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে।
বিএনপি এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে নিয়েছিল। ২০১৮ সালে তাদের মোট প্রার্থীর ৫১ শতাংশ ছিলেন কোটিপতি। ২০০৮ সালে হারটি ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ।
এবার স্বতন্ত্রদের মধ্যে কোটিপতি প্রার্থীর হার বেশি। ১৬৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী (৪৭ শতাংশ) নিজেদের কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের কথা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, ৩৪৭। সংখ্যাটি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ছিল ১৩৪। এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্রদের ক্ষেত্রে উদার মনোভাব দেখাচ্ছে। ফলে দলের পদে থাকা অনেকেই স্বতন্ত্র হয়েছেন। শতাধিক আসনে ‘দলের স্বতন্ত্র’ প্রার্থী শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন।
ঋণগ্রস্ত প্রার্থী কমেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৭ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ ছিল। এখন তা কমে হয়েছে ২৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগের ৪৯, ওয়ার্কার্স পাটির ৪৩, স্বতন্ত্র ৪১, জাতীয় পার্টি-জেপির ৩১, জাসদের ২৯ ও জাতীয় পার্টির ২৭ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ রয়েছে।
এবারের নির্বাচনে ১৬৪ জন প্রার্থী রয়েছেন, যাঁদের আয় বছরে কোটি টাকার বেশি। সংখ্যাটি ২০০৮ সালে ছিল ৪৩ জন, ২০১৮ সালে ছিল ১৪৩ জন।
বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার কম আয় দেখিয়েছেন মোট প্রার্থীর ২৮ শতাংশ। উল্লেখ্য, দেশে এখন করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা। মানে হলো, কর দেওয়ার মতো আয় না থাকলেও অনেকে প্রার্থী হয়েছেন। বছরে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন প্রায় ২৮ শতাংশ প্রার্থী।
টিআইবি দেখিয়েছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৬০ জন সংসদ সদস্যের আয় ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কমেছে ৩৭ জনের। অপরিবর্তিত আছে ১০৭ জনের। অন্যদের আয় ৫০ শতাংশের কম হারে বেড়েছে। পাঁচ বছরে ৫০ শতাংশের বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৬৭ জনের।
অনেকেরই আয় বেড়েছে বিপুলভাবে। সম্পদ বাড়ার হারও বহুগুণ। যেমন পাঁচ বছরে আয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের, হার ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ (প্রায় ৪ কোটি ৮৮ লাখ)। ১৫ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে রয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, হার ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ (প্রায় ১০ কোটি)। আরও অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের আয় ও সম্পদ বিপুলভাবে বেড়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সম্পদের বিকাশ যদি বৈধভাবে হয়ে থাকে, তাতে কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু অবৈধভাবে হলে এবং তথ্য গোপন করা হলে জবাবদিহি প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রার্থীদের তথ্য যাচাইয়ের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, রাজস্ব বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। তারা নিজেদের ভূমিকা রাখছে না।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি বলেছে, তাদের কাছে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে যুক্তরাজ্যে একাধিক কোম্পানি রয়েছে, যা হলফনামায় দেখানো হয়নি। মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো যুক্তরাজ্যে আবাসন ব্যবসা পরিচালনা করছে। ছয়টি কোম্পানির বর্তমান সম্পদমূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নাম জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেহেতু তথ্য গোপনের ব্যাপার রয়েছে এবং তিনি নিজে তা প্রকাশ করেননি, তাই টিআইবি তাঁর নাম প্রকাশ করা এখতিয়ারবহির্ভূত বলে মনে করে। তবে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ যদি টিআইবির কাছে চায়, তাঁরা তথ্য-প্রমাণ দেবেন।
হলফনামা বিশ্লেষণ করে অনেক প্রার্থীর বিপুল কৃষি ও অকৃষি জমি থাকার তথ্য তুলে ধরে টিআইবি। যেমন কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক গোলাম কবির ভূঞার সবচেয়ে বেশি ৬৪৬ একরের বেশি কৃষিজমি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৮১৩ একর অকৃষিজমির মালিক জামালপুর-৫ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. জাকির হোসেন।
টিআইবি বলছে, ভূমি সংস্কার আইন-২০২৩ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারেন না। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার চাইলে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
এবারের নির্বাচনে ৫৭ শতাংশ প্রার্থী স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। স্বশিক্ষিত বলে নিজেকে উল্লেখ করেছেন ১৩ শতাংশ প্রার্থী। ২ শতাংশের মতো প্রার্থী নিজেদের সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বলে উল্লেখ করেছেন।
রাজনীতিতে ব্যবসায়ী বাড়ছে। এবার ৫৭ শতাংশের কিছু বেশি প্রার্থীর মূল পেশা ব্যবসা, ২০০৮ সালে হারটি ছিল ৪৭ শতাংশের মতো। ফলে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ীর পরে রয়েছেন আইন, কৃষিকাজ, চাকরি ও শিক্ষকতায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা। ৩ শতাংশের কম প্রার্থী নিজেদের মূল পেশা রাজনীতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যবসা ও রাজনীতি এখন একাকার হয়ে গেছে। রাজনীতিতে যাঁরা আসেন, তাঁদের অনেকে ব্যবসার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর ব্যবসায়ীদের অনেকে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে রাজনীতির সুযোগ নেন। এতে অনেক আইন ও নীতি প্রণয়নে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
টিআইবির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এখন মামলা আছে ৯ শতাংশের কিছু বেশি প্রার্থীর। অতীতে মামলা ছিল ১৮ শতাংশ প্রার্থীর।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির তৈরি করা নির্বাচনী হলফনামার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন এই গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম প্রমুখ।
সার্বিক বিষয়ে সুলতানা কামাল বলেন, একটা শ্রেণি এতটাই সম্পদশালী হয়েছে যে ভাবলে হতবিহ্বল হয়ে পড়তে হয়। অন্যদিকে একটি বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠী দিন আনে দিন খায় অবস্থাতেও নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো এটা নয়।