বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে ভারত—এক ওয়েবিনারে এই অভিযোগ এসেছে বক্তাদের বক্তব্যে। তাঁরা বলেছেন, নিজেদের সুবিধা আদায়ে ভারত বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে এক ‘অন্যায্য’ অবস্থান গড়ে তুলেছে। এর পেছনে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও জনসাধারণের ‘সব মেনে নেওয়ার’ মানসিকতাও অনেকখানি দায়ী বলেও মনে করেন তাঁরা।
ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তাদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে এসেছে। আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী: বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব’।
ওয়েবিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি অভিযোগ করেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ভারত।’ এমন অভিযোগের ব্যাপারে যুক্তি দিতে গিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, প্রথমত, ভারতের বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার অভিলাষ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদের রয়েছে নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ। তৃতীয়ত বলা যায়, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সীমিত রাখতে চায় ভারত।
আলী রীয়াজ উল্লেখ করেন, এই তিনটি কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত কুশীলবে পরিণত হয়েছে। ফলে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে এবারের নির্বাচনে এ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশে গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতীয় বিশ্লেষকেরাও আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ। ওয়েবিনারে এ ব্যাপারেও তিনি কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কোনো জরিপ ছাড়াই ভারতীয় বিশ্লেষকেরা বুঝেছিলেন যে বাংলাদেশে ক্ষমতার হাতবদল হতে পারে। শেখ হাসিনা সরকার না থাকলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, ভারতের বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, ক্ষমতার হাতবদল হলে বিএনপি, জামায়াত ক্ষমতায় আসবে, মৌলবাদীদের উত্থান হবে। জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার ধারেকাছে থাকলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চালকের ভূমিকায় আসবে। এ ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় এলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে পারে। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাবও জরুরি। তবে আলী রীয়াজ মনে করেন, এসব যুক্তির কোনোটির বস্তুনিষ্ঠতা ছিল না।
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের জন্য আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক। আগে মনে করা হয়েছিল, বিজেপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের সুবিধা হবে না। সেটা হয়নি। পারস্পরিক স্বার্থই এখানে বড়।
ভারত ও চীনের স্বার্থ দেখার জন্য দেশের অভ্যন্তরেও অনেক মানুষ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক উঁচু পর্যায়ের মানুষ আছেন, যাঁরা ভারত ও চীনের স্বার্থ দেখেন। চীনের প্রকল্প বিক্রি করতে উঠেপড়ে লাগেন। কারণ, এতে তাঁদেরও স্বার্থ আছে। ফলে বাংলাদেশে যে দলই আসুক, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নেয় ভারত। ভারতের দিক দিয়ে এটা দোষের কিছু নয়। তিনি এ–ও বলেন, ভারতকে বাংলাদেশের মানুষ ভালোবাসে কি না, সেটাও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ অঞ্চলে মূল খেলোয়াড়ের ভূমিকায় থাকতে চায় ভারত।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ইউনিভার্সিটি অব ডালাসের শিক্ষক শাফকাত রাব্বী বলেন, ‘নিজেদের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নেওয়ার ভারতের এই চারিত্রিক অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও জনগণের একরকম ‘মেনে নেওয়ার’ চরিত্র গড়ে উঠছে। এ ব্যাপারে উদাহরণ দিতে গিয়ে শাফকাত রাব্বী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ক্রেডিট কার্ড দিয়ে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করছে ভারতে। চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। এমনকি বিয়ের হলুদ অনুষ্ঠান—সবকিছুতে ভারতকে নকল করার প্রবণতা রয়েছে। এসব অবস্থার পরিবর্তন না হলে ভারতের আধিপত্যবাদ থেকে উত্তরণ ঘটবে না।
ভারত বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে কতটা সম্মান করছে, সেই প্রশ্নও আলোচনায় আসে ওয়েবিনারে। টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, বাংলাদেশের কিছু মানুষ মনে করছে, ভারত বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করছে না। ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত। তিনি মন্তব্য করেন, দুই দেশের সম্পর্ককে ন্যায্যতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে ভারতকেই প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
সূচনা বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহমুদুল হাসান। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মনির হায়দার।