দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন

ভোটার উপস্থিতি কত হবে, সেটি মূল চিন্তা 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য। এ নির্বাচনে তারা ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতি দেখাতে চায়। এ জন্য দলটির কিছু কর্মকৌশলও আছে। তবে বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের ভোট বর্জন ও আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ভোটের হার বাড়ানোর লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। 

আগামীকাল রোববার সকাল আটটা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হবে, চলবে চারটা পর্যন্ত। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ বেশ কিছু দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা জনগণকে ভোট দিতে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ১০ দিন ধরে সারা দেশে গণসংযোগ কর্মসূচি চালিয়েছে। দলটি ভোটের দিন হরতাল কর্মসূচি দিয়ে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোটাররা কতটা ভোটমুখী হবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে এমনিতেই ভোটার উপস্থিতি কম থাকে। তা ছাড়া টানা তিন দিনের ছুটিতে শহরের অনেক ভোটার গ্রামের বাড়ি চলে যেতে পারেন।

২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। সে নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে বলে জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব দল অংশ নিলেও এ নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক ছিল। সেবার ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছিল বলে জানায় ইসি। 

এর আগে ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নির্বাচনগুলোতে সারা দেশে মোট ভোটারের ২৫-৩০ শতাংশের সমর্থন পেয়েছিল বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৮–৪১ শতাংশ। সে হিসাবে বিএনপির অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ ভোটার আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সাধারণ ভোটারদের অনেকে এবার ভোটে আগ্রহী না-ও হতে পারেন।

৩০০ আসনের মধ্যে এবার সব মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হতে পারে ১৩০টির মতো আসনে। এই আসনগুলোতে ভোট পড়ার হার ভালো হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। তবে যেখানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই সেখানে সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা কঠিন। আর বড় শহরগুলোতে অতীতেও বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটারদের অনীহা দেখা গেছে। ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। সে নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোট পড়ার হার ছিল ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ।

গত বছর অনুষ্ঠিত গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। ওই নির্বাচনগুলোতে ভোট পড়ার হার ছিল ৪৭ থেকে ৫৮ শতাংশ। অবশ্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে ভোটের হার বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখেন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির বর্জনের ফলে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা। তখন এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। এবার যাতে সে ধরনের পরিস্থিতি না হয়, সেদিকে শুরু থেকেই সতর্ক ছিল আওয়ামী লীগ।

সাধারণত দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে থাকে আওয়ামী লীগ। এমনকি দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। এবার তা হয়নি। বরং দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এর পেছনে মূলত দুটি কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানো, দ্বিতীয়ত, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেছেন, দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।

আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, এই কৌশলের বাইরে ক্ষমতাসীনেরা ভোটার বাড়াতে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি কাজ করবে। কেন্দ্রে ভোটার আনতে প্রশিক্ষণ দিয়ে কয়েক লাখ কর্মী তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। এর বাইরে গত সেপ্টেম্বরে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে সারা দেশের জন্য ১২টি দল গঠন করা হয়। প্রতিটি দল গড়ে পাঁচ থেকে সাতটি সাংগঠনিক জেলার দায়িত্ব পায়। এসব জেলা থেকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের থেকে বাছাই করে প্রচারকর্মীর তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর তাঁদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

 তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন মহল বলছে, ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে অনেক পদক্ষেপ থাকলেও সেগুলো কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আওয়ামী লীগের একজন জে্যষ্ঠ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে নির্বাচন ঘিরে এবার উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভোটারদের যে উৎসাহ ও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় ভোটার উপস্থিতি বেশ ভালো হবে। 

আওয়ামী লীগের ওই নেতা আরও বলেন, ২০১৪ সালের তুলনায় তাঁরা এবার বেশি ভোটার উপস্থিতি আশা করছেন। 

আওয়ামী লীগের দলীয় কৌশলের বাইরেও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আরও কিছু উদ্যোগ আছে। গত ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মতবিনিময় করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে কাজ করবেন কাউন্সিলররা। ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন পুলিশ সদস্যরা। ভোটারদের ভোট দিতে কেউ বাধা দিলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনও ভোটারদের উৎসাহিত করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন প্রচার চালাচ্ছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো তাদের কাজ নয়। 

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু এবার কিছু দল নির্বাচন বর্জন করেছে, তাই ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি অবশ্যই কিছুটা চ্যালেঞ্জের। ভোটারদের উপস্থিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়। আমাদের দায়িত্ব সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে, নির্দ্বিধায় ও নিরাপত্তার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেন এবং ভোটাররা নির্বিঘ্নে, পছন্দে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারেন। সে জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই কমিশন নিয়েছে।’