শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।  আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে

বুদ্ধিজীবী হত্যার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করার অনুরোধ জামায়াত সেক্রেটারির

১৪ ডিসেম্বর বেছে বেছে জাতির সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ড কারা ঘটিয়েছে, সেটি জাতির সামনে এখনো প্রকাশিত করা হয়নি। অনেকেই মনে করেন, জীবিত জহির রায়হানকে যদি পাওয়া যেত, তাহলে বুদ্ধিজীবী হত্যার আসল ইতিহাস এ জাতি জানতে পারত।

আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মিয়া গোলাম পরওয়ার এ কথা বলেন। তিনি সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন।

দীর্ঘ বক্তব্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করার অনুরোধ জানান।

উপস্থিতি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের যে দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরে। তার মাত্র দুই দিন আগে...মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো শুধু আমাদের ঘরেই না, সবার ঘরেই তো আছে। পড়ে দেখবেন, ১৬ ডিসেম্বরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, শহরের পতন ঘটছে এবং পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করছে। তারা যখন রাজধানীর দিকে আসছে, ১৬ ডিসেম্বরে তখন এই বিজয়ের অনুষ্ঠান করে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সকল জেলায়, সকল নগরে, সকল শহরে একেক দিন পতন ঘটেছে, পরাজিত হয়েছে। পাকিস্তানির সৈন্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে পলায়ন করেছে, ঢাকার দিকে ফিরছে, ক্যান্টনমেন্টের দিকে গিয়েছে। তারা তখন জীবন বাঁচানোর জন্য ব্যস্ত ছিল।’

জামায়াত নেতা মিয়া পরওয়ার বলেন, ‘ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা লাল–সবুজের পতাকা নিয়ে বিজয়ের স্লোগান দিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। ফলে যে পাকিস্তানিরা পরাজিত, তারা নিজের জীবন যেখানে রক্ষা করতে পারছে না, তাদের আত্মসমর্পণের অলরেডি সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। তারা একটা দেশ, একটা জাতির জন্য আর কী ক্ষতি করতে পারে, এটা একটা বিশ্লেষণের বিষয়। যাদের সাহায্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেছি বলে আধিপত্যবাদী শক্তির সেবাদাসেরা জাতির কাছে গর্বিত হতে চায়।’

‘জীবিত জহির রায়হানকে যদি পাওয়া যেত’

এ পর্যায়ে জামায়াত নেতা মিয়া পরওয়ার সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিত্রনির্মাতা, সাংবাদিক জহির রায়হান নিখোঁজ হয়ে গেলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে একজন যোদ্ধা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রাম, লড়াই, বুদ্ধিজীবী হত্যার এ সমস্ত ঘটনার ওপর একটা ডকুমেন্টারি প্রস্তুত করার জন্য গবেষণার কাজে হাত দিয়েছিলেন স্বাধীনতার অব্যবহিত পর। তিনি দেশের গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে তন্নতন্ন করে খুঁজে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের কারণ, তার তথ্য-উপাত্ত, তার প্রমাণ, ছবি—এগুলো সংগ্রহ করে ডকুমেন্টারি তৈরি করার জন্য মাঠে নেমেছিলেন। জাতি ভেবেছিল জহির রায়হানের ডকুমেন্টারি তৈরি হলে অজানা এই সব ইতিহাস এবং সত্য বেরিয়ে আসবে।’

পরওয়ার বলেন, ‘অজ্ঞাত কারণে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে জানা গেল জহির রায়হান নিখোঁজ, তাঁকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। আজও বাংলাদেশে সুচিন্তিত রাজনীতি যাঁরা করেন, মুক্তিযুদ্ধের ওপর যাঁরা গবেষক, যাঁরা বোদ্ধা রাজনীতিবিদ—তাঁদের কাছে এ রহস্যটি আজও অনাবিষ্কৃত। সেই জহির রায়হানের লাশও পাওয়া যায়নি। অনেকেই মনে করেন, জীবিত জহির রায়হানকে যদি পাওয়া যেত, তাহলে বুদ্ধিজীবী হত্যার আসল ইতিহাস এ জাতি জানতে পারত।’

‘দুটি কারণে ভারত মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল’

ভারত কখনো চায়নি বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক—এ অভিযোগ করে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ভারত বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘খুব নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে আপনারা দেখুন, ভারত আমাদের স্বাধীন দেশ হোক, দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, আমরা কারও কাছে পদানত করব না, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কখনো নতজানু হবে না, আমরা দুনিয়াতে স্বাধীন সভ্য দেশ হব—বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার এই জায়গা থেকে কিন্তু ভারত আমাদের সাহায্য করেনি।’

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার পেছনে ভারতের দুটি কারণ ছিল’ বলে দাবি করেন জামায়াতের সেক্রেটারি। তিনি বলেন, এর একটি হলো, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের কাছে নির্মম পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ভারত সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তারা মনে করেছিল, পাকিস্তানি বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। ভারত তখনই চিন্তা করল দিস ইজ দ্য প্রপার টাইম। ’৬৫ সালে আমরা পরাজিত হয়েছি, এখন এখানে আমাদের ঢুকতে হবে। এই পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে ওই ’৬৫–এর পরাজয়ের গ্লানির প্রতিশোধ নিতে হবে। সেই জন্য তারা সৈন্য দিয়ে অস্ত্র দিয়ে...কিন্তু ভেতরে তাদের ওই অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। দৃশ্যত মনে হয়েছিল দেশটাকে তারা স্বাধীন করে দিয়েছে।’

পরওয়ার বলেন, ‘এর পেছনে ভারতের আরেকটা স্বার্থ জড়িত ছিল। চতুর্দিক ঘিরে ভারতের সীমান্ত, মাঝখানে তাদের পেটের ভেতর ছোট্ট একটা বাংলাদেশ। তারা মনে করেছিল, বাঙালি জেগেছে। এই মুক্তিযুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে এই দেশটা যদি আমি পাকিস্তানিদের কাছ থেকে আলাদা করে দিতে পারি, তাহলে আমার দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, কলকারখানা, সংস্কৃতি—সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে আমরা একটা করদ রাজ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রে দেশটাকে ব্যবহার করতে পারব। সে জন্য তারা এখানে সাহায্য করেছে।’

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল। তিনি বলেন, বিজয়ের এক দিন আগে বেছে বেছে সাংবাদিক, শিল্পী, গবেষক, শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করল কারা? এটি স্পষ্ট, আধিপত্যবাদীরাই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে বর্গা দিয়েছিল। ৫ আগস্ট এ দেশের ছাত্র-জনতা আমাদের স্বাধীনতা ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করে এনেছে।’

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য আবদুস সবুর ফকির, কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য মু. দেলোয়ার হোসেন, মো. কামাল হোসাইন, আবদুল মান্নান, মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য নূর নবী মানিক প্রমুখ।