জাতীয় পার্টির প্রার্থী আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধী ভোট টানতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।
সকাল থেকেই ছিল থেমে থেমে বৃষ্টি। কখনো হালকা, কখনো ভারী। প্রতিকূল আবহাওয়াতেও বেশির ভাগ প্রার্থী বেরিয়েছেন গণসংযোগে, করেছেন নির্বাচনী সভাও। এভাবে গতকাল সোমবার প্রচারের শেষ দিনটি কাটিয়েছেন সিলেট সিটি নির্বাচনের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
ক্ষমতাসীন দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি এ নির্বাচনে নেই। গত দুটি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে জয় পাওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও দলের সিদ্ধান্ত মেনে প্রার্থী হননি। এবার আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. নজরুল ইসলামের (বাবুল) নাম আলোচিত হচ্ছে।
সিলেট নগরের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাধারণ ভোটারদের কেউ কেউ মনে করছেন, বিএনপিবিহীন ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগ খুব একটা স্বস্তিতে নেই। ভোটের সমীকরণে মূল আলোচনা চলছে সরকারবিরোধী ‘ভোটব্যাংক’ ঘিরেই।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, জাতীয় পার্টির প্রার্থী আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধী ভোট টানতে পারেন। এ ছাড়া মেয়র ও কাউন্সিলর পদে বিএনপির (সদ্য বহিষ্কৃত) ৪৩ জন এবং জামায়াতের ২০ নেতা-কর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। তাঁদের ভোট দিতে যদি দল দুটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী-সমর্থক ভোটকেন্দ্রে যান, তাহলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে পারেন।
আগামীকাল বুধবার সিলেট সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্র অনুযায়ী, নগরের ৪২টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৩ জন। এখানে মেয়র পদে ৮ জন এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর পদে ৩৬০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১৯০টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩২টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অন্য পাঁচজন হলেন জাকের পার্টির প্রার্থী মো. জহিরুল আলম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবদুল হানিফ (কুটু), মো. ছালাহ উদ্দিন (রিমন), মো. শাহ্ জামান মিয়া ও মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা। আর বরিশাল সিটি নির্বাচনের দিন দলের মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলার পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান সিলেটের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতে, বিএনপিদলীয় বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে না আসায় তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এগিয়ে আছেন। তবে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী ভোট যদি জাতীয় পার্টির প্রার্থী এককভাবে পান, তাহলে ভোটের হিসাব-নিকাশ অনেকটাই বদলে যেতে পারে। মূলত ভোটের মাঠে এ বিষয়টি এখন বেশি আলোচিত হচ্ছে।
সরকারবিরোধী ভোট নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা কিছুটা অস্বস্তিতে থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ কিছুই বলছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের টপকে মনোনয়ন পেয়েছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ নিয়ে দলের ভেতরে চাপা ক্ষোভ আছে। এর প্রভাব ভোটে পড়ে কি না, এমন শঙ্কার পাশাপাশি সরকারবিরোধী ভোট নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে।
যদিও সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন দাবি করেছেন, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় দলীয় অনেক ভোটার কেন্দ্রে যাবেন না। অন্যদিকে সিলেট মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহজাহান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভোটারদের উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত কোনোটাই করছি না। এ ভোট নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই।’
তবে বিএনপি ও জামায়াতের ওয়ার্ড পর্যায়ের পাঁচজন নেতা বলেন, বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট দিতে সরকারবিরোধী ভোটারদের একটি অংশের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এসব ভোটার স্বাভাবিকভাবে নৌকা প্রতীকে ভোট দেবেন না।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার পর্যবেক্ষণ, বিএনপিসহ কিছু দল নির্বাচন বর্জন করায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এ নির্বাচনে দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের অনেকে ভোটকেন্দ্রে না-ও যেতে পারেন। এ ছাড়া গত কয়েক দিনের মতো ভোটের দিনও বৃষ্টি থাকলে সাধারণ ভোটাররা কেন্দ্রবিমুখ হতে পারেন। অন্যদিকে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভোটারদের অনেকেই ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন। ভোটারদের উপস্থিতি যত কম থাকবে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী ততই সুবিধা পাবেন। তবে সরকারবিরোধী ভোট কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেটা নির্ভর করছে ভোটার উপস্থিতির ওপর।
অবশ্য সিলেট বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা জানান, বিএনপির যে ৪৩ নেতা সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের ইতিমধ্যে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। এরপরও দলের কিছু নেতা-কর্মী এসব প্রার্থীর সঙ্গে কাজ করছেন। বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত কিছু কিছু কাউন্সিলর প্রার্থী নিজের জয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। শেষ পর্যন্ত কৌশল হিসেবে এসব বিএনপিপন্থী প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ ভোটার-সমর্থকেরা আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু বিএনপি-জামায়াতের অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন, তাই দল দুটির সমর্থকেরা ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন বলেই আমরা মনে করছি। তবে তাদের ভোট শেষ পর্যন্ত কোন প্রার্থীর পক্ষে যাবে, সেটা এখন পর্যন্ত বুঝতে পারছি না। এটা বলতে পারি, তাদের চেয়ে আমাদের ভোট এ নগরে অনেক বেশি। তাই নৌকার বিজয় নিশ্চিত।’
স্থানীয় নাগরিক সমাজের দুজন ব্যক্তি বলছেন, মেয়র প্রার্থীদের যোগ্যতা ও অবস্থান বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয়ের পাল্লাই এখন পর্যন্ত ভারী। এ ছাড়া তাঁর প্রচারে দলসহ বিভিন্ন মহল সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। শহরে দলের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংকও রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মূল ভরসাই হচ্ছে সরকারবিরোধী ভোট।