বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন থেকে নানা অজুহাত দেখিয়ে পরিবহন ধর্মঘট ডাকছেন এ খাতের মালিক-শ্রমিকেরা। প্রথমে ময়মনসিংহে আনুষ্ঠানিক ধর্মঘট না ডাকলেও বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এরপর একে একে খুলনা, রংপুর, বরিশাল ও ফরিদপুরে ধর্মঘট ডাকেন পরিবহনমালিকেরা। সর্বশেষ আজ শনিবার বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সিলেটেও ধর্মঘট চলছে।
কুমিল্লা, রাজশাহী ও ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ আসন্ন। এই সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করেও একই কায়দায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিএনপির ছয়টি বিভাগীয় সমাবেশের মধ্যে পাঁচটি সমাবেশ ঘিরে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে কার লাভ কার ক্ষতি—এই আলোচনা শুরু হয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভেতরও বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে।
প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘটে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ‘বেসরকারি মালিকেরা ধর্মঘট ডাকলে আমরা কী করব’ এই ধরনের মন্তব্যও করেছেন সড়কমন্ত্রী। এমনকি পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) লোকজনও যে নেতৃত্বে আছেন, সেটিও বলেছেন ওবায়দুল কাদের।
কিন্তু মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের এই বক্তব্য কি আসল ঘটনা আড়াল করতে পারছে? আওয়ামী লীগের যদি দায় না-ই থাকে, তাহলে দলটি তো সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে, চাপ দিয়ে ধর্মঘট স্থগিত করাতে পারত। কিংবা দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েও ধর্মঘট স্থগিত করানো যেত। বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে ধর্মঘটগুলোর আগে মালিক সমিতি প্রশাসনের কাছে দাবিনামা তুলে ধরেছে। কোথাও বিষয়টি সুরাহার জন্য প্রশাসন বৈঠক করেছে—এমনটি শোনা যায় না। অথচ সাধারণ সময়ে ধর্মঘট ডাকলে বৈঠক করে তার সুরাহা করে সরকার।
বিএনপির সমাবেশ ঘিরে পরিবহন ধর্মঘটে আওয়ামী লীগের খুব বেশি লাভ দেখছেন না দলটির অনেকেই। দলটির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, চট্টগ্রামে পরিবহন ধর্মঘট না থাকার কারণে বিএনপির সমাবেশে বিপুল জমায়েত হয়েছে। অন্যগুলোতে এতটা হয়নি। এই একটিই ইতিবাচক দিক। কিন্তু ক্ষতির পাল্লাটা অনেক ভারী। বিশেষ করে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ধর্মঘট ডাকার কারণে অনেকেই ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, ভটভটি, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে অনায়াসে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। এই বিষয়গুলো ফলাও করে কয়েক দিন গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে।
বাধা-ধর্মঘট না থাকলে বিএনপির সমাবেশ গণমাধ্যমে এতটা প্রচার পেত কি না, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। বাধা দেওয়ার ফলে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মরিয়া ভাব বেড়েছে। চিড়া-মুড়ি নিয়ে সমাবেশে আসা, মাঠে আগের দিন থেকে অবস্থান নেওয়া—এসব বিষয় গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে, যা দেখে অন্য অঞ্চলে থাকা বিএনপির নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা বেড়ে যাচ্ছে। আর বাধা দেওয়ার কারণে বিএনপির সমাবেশে জমায়েত যে খুব কম হয়েছে, সেটাও তো প্রমাণিত নয়।
কেউ কেউ মনে করেন, আরেকটি বিষয় আওয়ামী লীগের জন্য নেতিবাচক হয়েছে। সেটি হলো বিএনপির সমাবেশের দিনে আওয়ামী লীগ কোনো না কোনো স্থানে দলের জেলা সম্মেলন করছে। এতে বিপুল মানুষের জমায়েত করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের এসব কর্মসূচিতে বিনা বাধায় মানুষ যোগ দিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির সমাবেশে যেতে পরিবহন বন্ধ করে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা হলো জনভোগান্তি। এক বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ বলছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে মানুষ তাদেরই আবার ভোট দেবে। কিন্তু যে মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে বলা হচ্ছে, সেই মানুষকেই ধর্মঘটের কারণে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সরকার বা আওয়ামী লীগ তা নিরসনে কিছুই করছে না। তাহলে তাদের কাছে কী ইতিবাচক বার্তা যাবে? ধর্মঘটের কারণে রোগী, শিক্ষার্থী, কর্মজীবী, ব্যবসায়ী—সর্বোপরি ওই এলাকার সব মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই ইতিবাচক ফল দেওয়ার কথা নয়।
বিএনপির সমাবেশে বাধা দেওয়া যে জনমনে বিরূপ মনোভাব তৈরি করছে, তা উঠে এসেছে পুলিশের একটি শাখার প্রতিবেদনে। গত ১২ অক্টোবর ফরিদপুরে বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়, যেকোনো কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গণপরিবহন বন্ধ থাকলে কর্মসূচি আহ্বানকারী রাজনৈতিক দল যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয় বেশি হয়। এতে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন কিছুটা হলেও কমে। সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ধরে রাখতে ও জনদুর্ভোগ এড়াতে সমাবেশের আগে গণপরিবহন চালু রাখা যেতে পারে।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবহনের মালিক ও শ্রমিকদের বড় অংশই অরাজনৈতিক। তবে এখন সারা দেশে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা কিংবা সমর্থিতরা। কারও কারও অনুমান হচ্ছে-বর্তমানে মূল নেতৃত্বের ৮০ শতাংশই আওয়ামী লীগঘেঁষা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলের অনুসারীরা বা নেতারা পরিবহন খাতের নেতৃত্বে আসেন।
সারা দেশের পরিবহন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত মসিউর রহমান ওরফে রাঙ্গা। তিনি সরকারঘেঁষা বলে পরিচিত। এই সংগঠনের মহাসচিব ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। অন্য নেতাদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত। মসিউর সভাপতি হলেও সংগঠনটি পরিচালনার মূল ভূমিকায় রয়েছেন এনায়েত উল্যাহ।
শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা আছে, ২০১৪ সালে শাজাহান খানকে নৌপরিবহনমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া এবং পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করার পেছনে তাঁর শ্রমিক রাজনীতি ভূমিকা রেখেছে। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বাসদের রাজনীতিতে যুক্ত। তবে তিনি সংগঠনটিকে রাজনীতিকীকরণের বিরোধী বলে জানা যায়। আর বিএনপিপন্থী একমাত্র নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। কিন্তু তিনি ঠিকমতো সংগঠনের বৈঠকে যোগ দেন না বলে জানা গেছে। জেলা পর্যায়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর প্রায় সবগুলোর সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক ক্ষমতাসীন দলের। কমিটির অন্যরাও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবার বিএনপির সমাবেশ ঘিরে যত ধর্মঘট হয়েছে, এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষে ধর্মঘটের বার্তাটা এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে নেতারাও ধর্মঘট ডাকার বিষয়ে পরামর্শ-নির্দেশনা দিয়েছেন। এতে প্রকৃত বাস কোম্পানির মালিকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সাধারণ শ্রমিকেরা আয় বঞ্চিত হয়েছেন।
সড়ক ও মহাসড়কে অবৈধভাবে নছিমন, করিমন, মাহিন্দ্র, ইজিবাইক ও বিআরটিসির বাস চলাচল বন্ধ করার দাবিতে মূলত এত দিন ধর্মঘট হয়েছে। সর্বশেষ সিলেটে ধর্মঘট ডাকার কারণ হিসেবে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গ্রিল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ও অবৈধ অটোরিকশার নিবন্ধন না দেওয়ার দাবির কথা বলা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন আইনের প্রয়োগ বন্ধ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়ি, পরিবহনশ্রমিকদের মারধর—এসব কারণে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘটের ডাক দেয়। তাদের সঙ্গে প্রশাসন আলোচনায় বসে সমাধানও করে। কিন্তু বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে ধর্মঘটের বেলায় এমন কোনো তাগিদ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় প্রশাসনে এখনো দেখা যায়নি।
শ্রম আইন কিংবা সড়ক পরিবহন আইনে পরিবহনমালিকদের ধর্মঘট ডাকার কোনো বিধান নেই। পরিবহনমালিক চাইলে তাঁর ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের যথাযথ পাওনা পরিশোধ করার নিয়ম। অন্যদিকে শ্রম আইনে দাবিদাওয়া আদায়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট ডাকার সুযোগ আছে। তবে দাবিগুলো অন্তত ১৫ দিন আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করার বিধান রয়েছে।
বিএনপির সমাবেশ ঘিরে যেসব ধর্মঘট হয়েছে, এর বেশির ভাগ দুই থেকে পাঁচ দিন আগে ডাকা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিবারই ঘোষিত সময়ের দুই-তিন ঘণ্টা আগে বাস চালু হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিএনপির সমাবেশ শেষ হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলেই ধর্মঘট শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে এসব ধর্মঘট নির্দিষ্ট কোনো দাবি আদায়ের, নাকি রাজনৈতিক, সেই প্রশ্ন উঠছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলে এই রাজনৈতিক ধর্মঘট আওয়ামী লীগের কোনো উপকার করবে না, সেটা স্পষ্ট। অন্যথা হলে ভিন্ন কথা।