যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গত বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের নবম ধীরগতির শহর ময়মনসিংহ। শহরটির বাসিন্দাদের দিনের একটা বড় সময় কাটে যানজটে। বাসিন্দাদের অনেকের কাছে যানজটের এই পরিস্থিতি হলো ‘ধীরগতির দুর্গতি’। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র প্রার্থীরা এই দুর্গতি কমিয়ে স্বস্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ভোটারদের।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এলাকায় যানজটের এই ভোগান্তি দীর্ঘদিনের। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগে থেকেই এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন। গত শুক্রবার প্রতীক বরাদ্দের পর গতকাল শনিবার প্রার্থীদের দ্বিতীয় দিনের প্রচারেও যানজটের বিষয়টি উঠে আসে।
ময়মনসিংহ পুরোনো শহর। এখানকার সড়ক অপ্রশস্ত। গত ৪০ বছরে সড়ক বাড়েনি; কিন্তু যানবাহন বেড়েছে বহুগুণ। তাই এই শহর এখন যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে। সীমিত জনবল দিয়ে ট্রাফিক বিভাগ তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।ময়মনসিংহ ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাটগুদাম, চরপাড়া, গাঙ্গিনার পাড়, ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকা, নতুন বাজার, জিলা স্কুল মোড়, টাউন হল মোড় ও আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার এলাকায় যানজট বেশি। এসব এলাকায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানবাহনের ভিড় লেগে থাকে। দুপুরে শহরের নতুন বাজার, জিলা স্কুল মোড়, টাউন হল মোড় এলাকায় শত শত তিন চাকার যান—ইজিবাইক (ব্যাটারিচালিত রিকশা) ও রিকশা আটকে থাকে। বিশেষ করে স্কুল ছুটির পর দুপুরে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। তাই অনেকে হেঁটে গন্তব্যে যান।
ময়মনসিংহ শহরে যানজটের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে জানান সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে রয়েছে অপ্রশস্ত সড়ক, সড়কের ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত ইজিবাইক, অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ ও শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেললাইন যানজটের মূল কারণ।
ময়মনসিংহ শহরের আকুয়া হাজীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা জিয়াউর রহমান প্রতিদিন পেশাগত কাজে বাসা থেকে পাটগুদাম এলাকায় যাতায়াত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০ মিনিটের পথ যেতে ৪০ মিনিটের বেশি সময় লাগে। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই শহরের সড়কের শৃঙ্খলা পুরো ভেঙে পড়েছে।
পাঁচ বছর আগে সিটি করপোরেশনের মর্যাদা পায় ময়মনসিংহ। বিভাগ ও সিটি করপোরেশন হওয়ায় শহরে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। মানুষ ও যানবাহনের চাপ বাড়লেও বাড়েনি সড়কের পরিধি।
ধীরগতির শহরে যানজটে ভোগান্তি
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ গত অক্টোবরে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গবেষণায় ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করা হয়। তিন লাখের বেশি মানুষের বসবাস, এমন সব শহরে গাড়িতে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে কত সময় লেগেছে, সেসব তথ্য গুগল ম্যাপ থেকে সংগ্রহ করে গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরের তালিকায় ময়মনসিংহ নবম অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষে ছিল রাজধানী ঢাকা।
ধীরগতির শহর হওয়ায় ময়মনসিংহের সংস্কৃতিজনেরা তখনই ‘ধীরগতির দুর্গতি’ নামে প্রতিবাদী কর্মসূচির আয়োজন করেছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন উদ্যানে ব্যতিক্রমী এ আয়োজনে সাধারণ নাগরিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা যানজট থেকে নিস্তার পেতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর জোরালো ভূমিকার দাবি জানান।
ময়মনসিংহ ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ময়মনসিংহ পুরোনো শহর। এখানকার সড়ক অপ্রশস্ত। গত ৪০ বছরে সড়ক বাড়েনি; কিন্তু যানবাহন বেড়েছে বহুগুণ। তাই এই শহর এখন যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে। সীমিত জনবল দিয়ে ট্রাফিক বিভাগ তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
পাঁচ বছর আগে সিটি করপোরেশনের মর্যাদা পায় ময়মনসিংহ। বিভাগ ও সিটি করপোরেশন হওয়ায় শহরে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। মানুষ ও যানবাহনের চাপ বাড়লেও বাড়েনি সড়কের পরিধি। শহরের ভেতরে সিটি করপোরেশনের মূল সড়কের সর্বোচ্চ প্রস্থ ৩৪ ফুট। অর্থাৎ প্রতি পাশে মাত্র ১৭ ফুট দিয়ে যানবাহন চলে।
গত তিন দিন শহরের ব্যস্ততম এলাকা গাঙ্গিনার পাড়, নতুন বাজার ও চরপাড়া ঘুরে দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর ফুটপাত হকারদের দখলে। এলাকার লোকজন জানান, সিটি করপোরেশন মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ফুটপাত দখলমুক্ত করলেও কিছুদিনের মধ্যে আবার তা দখল হয়ে যায়।
ময়মনসিংহ শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেলপথের কারণে যানজট আরও দীর্ঘ হচ্ছে। বর্তমানে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১০টি এলাকায় রেলক্রসিং রয়েছে। এসব রেলক্রসিং দিয়ে দিনে ৫০ বারের মতো ট্রেন যাতায়াত করে। প্রতিবারই ৮ থেকে ১০ মিনিট করে ক্রসিংয়ের দুই পাশের যান চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। একটি ট্রেন যাওয়ার পর অনেকটা সময় লেগে যায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে।
যানজট বাসিন্দাদের ভোগান্তি এতটাই বাড়িয়েছে যে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান নিজে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। গত রোববার সন্ধ্যায় মিন্টু কলেজের সামনে ও গত সোমবার দুপুরে চরপাড়া-গাঙ্গিনার পাড় সড়কের ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যানজট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তিনি। সড়কে দাঁড়িয়ে লেন মেনে গাড়ি চলতে নির্দেশনা দেন।
অটোরিকশার নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ নগরবাসী
ময়মনসিংহ শহরের ভেতরে বাসের মতো কোনো গণপরিবহন নেই। সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চার ধরনের ইজিবাইক-অটোরিকশা
চলছে সড়কে। এর মধ্যে বর্তমানে নিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। মোটা চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি এবং চিকন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে ছয় হাজার। পায়ে চালিত রিকশার সংখ্যা ৪০০। এর মধ্যে ইজিবাইক ও মোটা চাকার রিকশা দুই ভাগে ভাগ হয়ে প্রতিদিন অর্ধেক সংখ্যক চলাচল করে।
তবে নাগরিকদের অভিযোগ, প্রকৃতপক্ষে নগরে ইজিবাইক ও রিকশার সংখ্যা আরও বেশি।
প্রার্থীদের প্রাধান্য যানজট কমানোয়
সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ২০১৯ সালের ৫ মে ময়মনসিংহে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ৩৩টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ভোটে নির্বাচিত হলেও ইকরামুল হক (টিটু) মেয়র নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল (টেবিলঘড়ি প্রতীক) এবারও মেয়র প্রার্থী হয়েছেন।
ইকরামুল ছাড়াও এবার মেয়র পদে লড়ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক), জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান (হাতি প্রতীক), জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী শহিদুল ইসলাম (লাঙ্গল প্রতীক) ও মো. রেজাউল হক (হরিণ প্রতীক)। আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এই প্রার্থীরা শহরের বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগামাধ্যমে নানা ধরনের পোস্ট দিচ্ছেন। সব ক্ষেত্রেই যানজট কমানোকে প্রাধান্য দিচ্ছেন প্রার্থীরা।