‘রংপুর এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি গাইবান্ধার বোনারপাড়া স্টেশনে থামতেই শতাধিক মানুষ হুড়মুড় করে বগিতে উঠে পড়লেন। প্রায় সবার মাথায় সবুজ কাপড়ের ব্যান্ড। তাতে লেখা ‘সাঘাটা থানা’। বুঝতে বাকি রইল না, তাঁরা সবাই রংপুরের যাত্রী।
আজ শনিবার বেলা দুইটায় রংপুর শহরের কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। হুড়মুড়িয়ে ওঠা লোকেরা সবাই সেখানেই যাচ্ছেন। ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ ট্রেনের স্নিগ্ধা ‘গ’ বগিটির সব আসনে আগে থেকেই যাত্রী ছিল। বোনারপাড়ায় যাঁরা উঠলেন, সবাই যাত্রীদের হাঁটার পথে ঠাসাঠাসি দাঁড়িয়ে পড়লেন।
হুট করে ওঠা যাত্রীদের সরগরম ভিড়ে বিপাকে পড়েন ট্রেনে বসে থাকা যাত্রীরা। বোনারপাড়ার পরের স্টেশন গাইবান্ধায় নামার কথা একজন নারী যাত্রীর। ভিড় ঠেলে বহু কষ্টে মালপত্র নিয়ে তিনি ট্রেনের দরজায় পৌঁছাতে পারেন।
ঢাকা থেকে আসা আমার পাশের আসনের যাত্রী গাইবান্ধায় নেমে গেলেন। হাতে একটি কালো ব্যাগ নিয়ে বয়স্ক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিলেন কাছেই। বোনারপাড়ায় বগিতে হুড়মুড় করে ওঠা অনেক মানুষের মধ্যে তিনি একজন। আশপাশের সবাই আমার পাশের খালি আসনটিতে ডেকে বসালেন তাঁকে।
পরিচয়-আলাপে জানলাম, তিনি আবদুল হামিদ। তিনি সাঘাটার সিংদিয়া বাজারের পল্লিচিকিৎসক। বললেন, তাঁরা রংপুরে বিএনপির সমাবেশে যাচ্ছেন। বাস-ট্রাক বন্ধ থাকায় এই ট্রেনের জন্য প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেনটি ধরতে না পারলে রংপুরে পৌঁছানোটাই অনেক কঠিন হয়ে পড়ত তাঁদের জন্য। তাই ট্রেনে উঠতে পেরেই সবার মুখে যেন রাজ্য জয়ের হাসি।
আবদুল হামিদ বলেন, তিনি সাঘাটার পদুমশহর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটায় সাঘাটা উপজেলার ডিমলা পদুমশহর গ্রামের বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছেন। রাতে কোথাও থাকা-খাওয়ার জায়গা না পেলে রংপুরে সমাবেশের মাঠে থাকবেন। তাই খাওয়ার জন্য চারটি কলা, দুটি পাউরুটি, সঙ্গে এক বোতল পানি রেখেছেন। পদুমশহর ইউনিয়ন থেকে তাঁরা ৯০ জন সমাবেশে এসেছেন। তাঁর জানামতে, পুরো সাঘাটা থেকে এসেছেন আরও প্রায় দুই হাজার নেতা-কর্মী।
আবদুল হামিদদের গ্রাম পদুমশহর থেকে রংপুর শহরের কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ৬০ বছর বয়সের এই জীবনে এত দূরত্বে গিয়ে কখনো রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দেননি বলে জানান আবদুল হামিদ। তা–ও আবার সমাবেশের এক দিন আগেই সেই যাত্রা। আবার রাত কাটাতে হবে সেই সমাবেশের মাঠে। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে।
আবদুল হামিদ বলেন, ভোট ডাকাতি নিয়ে আওয়ামী লীগের ওপর গাইবান্ধার মানুষ বেশি বিরক্ত। বিশেষ করে চলতি মাসেই জোরজবরদস্তি ভোট ডাকাতি করতে দিতে গিয়ে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বানচাল হওয়ার পর মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ। তিনি নিজেও এই ভোট ডাকাতির একজন সাক্ষী। কারণ, বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ না নিলেও তিনি এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে স্থানীয় মজিদের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ছিলেন।
রাত আটটায় ট্রেনটি যখন রংপুর স্টেশনে পৌঁছায়, তখন সব বগি থেকেই একযোগে স্লোগান ওঠে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম মিছিলে ভরে যায়। রাত নয়টায় ঈদগাহ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন জেলা থেকে নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা হাজির হচ্ছেন।
রাত ১০টার দিকে দেখা গেল, মাঠে জটলা বেঁধে আছেন ৮-১০ জন নারী। তাঁদের একজন মৌসুমী আক্তার (তমা)। বললেন, তিনি গাইবান্ধা জেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক। তাঁরা পাঁচটি ভ্যান ও অটোরিকশায় করে ভেঙে ভেঙে গাইবান্ধা থেকে রংপুরে এসেছেন। সবাই দলের সক্রিয় নেতা-কর্মী বলে জানান মৌসুমী।
তাহলে কি বিএনপির এই সমাবেশ ঘিরে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম? মৌসুমী আক্তারের জবাব, ‘আমি তো দেখছি, আমাদের নেতা-কর্মীদের চেয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আরও বেশি। একটা উদাহরণ দিই, আমরা যে অটোতে করে এসেছি, শহরে আসার পর ভাড়া দেওয়ার সময় চালক বলে কী, আপা, আপনারা ২০০ টাকা কম দেন অথচ পরিবহন ধর্মঘটের এই সময়ে তাঁর তো ২০০ টাকা বেশি চাওয়ার কথা ছিল।’
রাত সাড়ে ১০টায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা থেকে সমাবেশ মাঠে পৌঁছান দুই বন্ধু আশরাফ হোসেন ও আবদুল মোমেন। মোমেন কুড়িগ্রাম জেলা যুবদলের সহসভাপতি ও আশরাফ থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দুজন প্রায় ৮৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন এক মোটরসাইকেলে।
আবদুল মোমেন বলেন, রাস্তায় দুই জায়গায় পুলিশ তাঁদের আটকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। লালমনিরহাটের তিস্তা ও কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর সেতুর ওপর পুলিশ তাঁদের থামিয়ে কাগজপত্র দেখেছে। তারপর জিজ্ঞেস করেছে, রংপুরে কেন যাবেন, সমাবেশে যাচ্ছেন কি না। তবে তাঁরা চলে এসেছেন।
রংপুরের সমাবেশ ঘিরে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার মতো বাধাবিপত্তির ঘটনা খুব একটা নেই। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রংপুর শহরের সঙ্গে সাত জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যে নেতা-কর্মীরা বিভিন্নভাবে রংপুরে এসেছেন।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীরা গতকাল রাতে নগরের উত্তম এলাকার গুদাম, স্কুলঘর এবং রবার্টসনগঞ্জ স্কুল ও মাঠে ছিলেন। অনেকে সমাবেশস্থলে ছিলেন।
কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে গতকাল সন্ধ্যায় সমাবেশস্থলে এসেছেন রবিউল ইসলাম। তিনি উলিপুরের ধামশ্রেণি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। রবিউল বলেন, তাঁরা আটজন অটোরিকশাতে রংপুর এসেছেন। এ জন্য যাত্রাপথে তাঁদের চারবার অটোরিকশা বদলাতে হয়েছে।
রবিউল বললেন, তাঁর সীমিত আয়ের সংসার। এক দিন কাজ না করলে সংসারে টানাপোড়েন তৈরি হয়। তবু এক হাজার টাকা সংগ্রহ করে এসেছেন তিনি। এর মধ্যে যাত্রাপথে খরচ হয়েছে ৩০০ টাকা।
রবিউল বলেন, ‘কথা বলতে পারি না। রাজনীতি করতে পারি না। কত দিন আর বাড়িতে বসে থাকমো। সাহস করি বেড়ি (বেড়িয়ে) আসছি।’
বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত পঞ্চগড়ের আফসার আলী সমাবেশস্থলে এসেছেন ভ্যান-অটোরিকশায় ও হেঁটে। আফসার বললেন, নীলফামারীর ডোমারে এসে তাঁদের ৮-১০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল।
আফসার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বললেন, ‘না পারি কাজ করতে, না পারি সোলানদারি (মানুষের বাড়িতে খেটে খাওয়া) করতে। খুবই কষ্ট করে চলছি। দুই কেজি চাল ১২০ টাকা, মাসে এক দিনও গরুর গোশত খেতে পারি না। এভাবে দেশ চলতে পারে না।’
পঞ্চগড়ের বোদার রিকশাচালক দেলোয়ার সমাবেশস্থলে ছিলেন। নিজেকে তিনি বিএনপির ছোট কর্মী বলে পরিচয় দিলেন। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বললেন, বড় কোনো সমাবেশে এটাই তাঁর প্রথম আসা। কোথায় থাকবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সমাবেশে আসছি, এইটাই বড় কথা। থাকা-খাওয়ার চিন্তা করার সময় নেই।’