উপনির্বাচন

আ. লীগকে পাশে না পেয়ে ১৪ দলের শরিকদের অনেক প্রশ্ন

  • শরিকদের জেতাতে তৎপর ছিল না আওয়ামী লীগ।

  • আ.লীগের সব মনোযোগ ছিল বিএনপির দলছুট উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে ঘিরে।

  • ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত।

  • জাসদ কোনোরকমে পরাজয় এড়িয়েছে।

রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু

বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসনের উপনির্বাচনে ১৪–দলীয় জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে অন্য শরিকদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন এবং কিছুটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি—দুই শরিককে দুটি আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, জোটের প্রার্থী জেতাতে আওয়ামী লীগের চেষ্টা, উদ্যোগ কিংবা সক্রিয় তৎপরতা ছিল না। জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির যতটুকু শক্তি আছে, তার ওপর ভিত্তি করেই তাদের ভোট করতে হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মূল মনোযোগ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে ঘিরে। শরিকদের স্ব স্ব শক্তি কতটা আছে, সেটা বোঝানোর জন্য আওয়ামী লীগ তাদের পরীক্ষায় ফেলেছিল কি না—এমন প্রশ্নেও নানা আলোচনা চলছে ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে। সার্বিকভাবে এই উপনির্বাচনকে নিজেদের জন্য ‘বার্তা’ হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগের শরিকেরা।

যে দুটি আসন শরিকদের ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ, তার একটিতে বগুড়া-৪ আসনে জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিমকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের সঙ্গে। সেখানে মাত্র ৮৩৪ ভোটে জয়ী হয়েছেন জাসদের প্রার্থী। আর ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ১৪ দল থেকে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ইয়াসিন আলী জামানতই হারিয়েছেন। এ ধরনের একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির দায় কার কিংবা কার ব্যর্থতা—এসব প্রশ্নই এখন আওয়ামী লীগের শরিকদের আলোচনায়। তবে শরিকদের প্রাথমিক মূল্যায়নে প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের প্রতি কিছুটা ক্ষোভও প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়া ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটি আসনে আওয়ামী লীগের নিজেদের প্রার্থী ছিল, তারা জয়ী হলেও সেই আসনগুলোতেও দলটির কৌশল নিয়ে শরিকেরা প্রশ্ন তুলেছে। তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, একমাত্র দলছুট প্রার্থী উকিল সাত্তারের আসনেই ক্ষমতাসীন দল সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল।

আওয়ামী লীগ অবশ্য পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করছে ভিন্নভাবে। দলটির নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি ভোটে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগের তিনজন প্রার্থী জিতবেন—এটা নিশ্চিতই ছিল। এ জন্য আওয়ামী লীগের সব চেষ্টা ছিল উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে নিয়ে।

তবে শরিকদের স্ব স্ব শক্তি দেখানোর পরীক্ষায় ফেলা হয়েছিল কি না—শরিকেরা যে এমন প্রশ্ন তুলেছেন, আওয়ামী লীগের কৌশলেই এর জবাব পাওয়া যায়।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করলে হয়তো ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হবে। তবে জয়ী করে আনার চেষ্টা থাকবে না। আর বিএনপি নির্বাচনে এলে জোটের প্রার্থীর পক্ষে সবাই একযোগে নামবে। এ জন্য আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ১৪ দলের অন্যতম দুই শরিক দলের শক্তি দেখতে চেয়েছে।

গত বুধবার অনুষ্ঠিত ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ-রানীশংকৈল আংশিক) আসনে ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলী জামানত হারিয়েছেন। সেখানে বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী গোপাল চন্দ্র রায়। ২০১৪ সালে জোটের প্রার্থী হিসেবে ইয়াসিন আলী এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি জোটের মনোনয়ন পেলেও বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান।

অন্যদিকে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। তিনি এর আগে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এই আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে জোটের মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান।

এবার উপনির্বাচনে জাসদ প্রার্থী রেজাউল করিমের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নানা কারণে আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম। ১০ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে তৃতীয় হন কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ হয়ে গেছে।

১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ নেতারা জোটের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে ছিলেন। এরপরও কোনো বিষয় থাকলে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, ১৪ দল নিয়মিত সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। উপনির্বাচন ও ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে।

আসন সমঝোতা, জেতানোর নিশ্চয়তা নয়

১৪–দলীয় জোট সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে ছয়টি আসনের মধ্যে দুটি আসন শরিকদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই করেনি। জোটের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার বিষয়ে বগুড়া ও ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগকে কোনো বার্তা দেয়নি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এ জন্য স্থানীয় নেতারা নিজেদের মতো করে ভোট করেছেন। এতেই কপাল পুড়েছে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীর। আর জাসদের প্রার্থী কোনোরকমে পরাজয় এড়িয়েছেন।

ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উকিল আবদুস সাত্তার দল বা জোটের প্রার্থী না হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ ওই আসনে তাদের তিনজন প্রার্থীকে চাপ দিয়ে বসিয়েছে। জাপার দুবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধাকে সরে যেতে হয়েছে। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির আবু আসিফ আহেম্মদ চাপের মুখে ভোটের মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ বগুড়া ও ঠাকুরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বসানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি দলটি। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেয়নি।

জাসদের সূত্র জানিয়েছে, বগুড়া-৪ আসনে জাসদের রেজাউল করিম ২০০৮ থেকে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে ভোট করেছেন। এবার তাঁকে নৌকা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল জাসদ। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি।

জাসদের একটি সূত্র বলছে, হিরো আলম যে ভোট পেয়েছেন, তা আওয়ামী লীগের। কারণ, বিএনপির ভোটাররা কেন্দ্রে আসেননি। শেষ দিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে এমন উপলব্ধি হয় যে হিরো আলম জিতে গেলে জোটের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে জাসদের প্রার্থীকে জয়ী করার বিষয়ে তাগিদ দেখা দেয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতা সম্পৃক্ত হন। কিন্তু কর্মী ও ভোটারদের টানতে পারেননি। অবশ্য জাসদের প্রার্থী কম ব্যবধানে হলেও জেতার পর স্বস্তি প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা।

জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, জোটগতভাবে প্রার্থী দেওয়া হলেও কেন্দ্র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছুটা সমন্বয়ের অভাব দেখা গেছে। এ জন্য স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ কাজ করেছেন, অনেকে পাশে ছিলেন না। আবার স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছেন। বিষয়গুলো নিয়ে পরে জোটে আলোচনা হবে।

আওয়ামী লীগের ভাবনা

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলে এমনিতেই জোটগতভাবে ভোট হওয়ার সম্ভাবনা কম। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে আসন সমঝোতা হবে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে, ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে শরিকদের ছেড়ে দেওয়া আসনেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকতে পারে। আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে শরিকেরা প্রার্থী দিলে বাধা দেওয়া হবে না। এমনকি বিএনপির কেউ দল ছেড়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে চাইলে আওয়ামী লীগ তাঁদের সর্বাত্মক সহায়তা করবে। জোটের শরিকদের আসনেও বিএনপির দলছুট কেউ প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীর পক্ষ নেবে না।

সূত্র জানায়, বিএনপি নির্বাচনে এলে বর্তমান ১৪ দলের যে জোট আছে, সেটি সম্প্রসারণ হতে পারে। জাপাসহ আরও অনেক দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হবে। সে ক্ষেত্রে জোটের সঙ্গী ও মিত্রদের কোন কোন আসনে ছাড় দেওয়া হবে, এই দর-কষাকষিই মুখ্য হয়ে উঠবে। এরপর আওয়ামী লীগ, জোট ও মিত্র যে দল থেকেই প্রার্থী হোক না কেন, সবাই মিলে জেতানোর চেষ্টা থাকবে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, উপনির্বাচনে হিরো আলমের সঙ্গে নিজেদের শক্তিতেই জাসদের প্রার্থীর জেতা উচিত ছিল। এতটুকু পরীক্ষা তো শরিকদের নেওয়াই দরকার। ওই নেতা আরও বলেন, উপনির্বাচনে জাপার সঙ্গে সমঝোতা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। সমঝোতা হলে ঠাকুরগাঁওয়ে জাপার হাফিজ উদ্দিনই আওয়ামী লীগের সমর্থন পেতেন। ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলী ২০১৪ সালে জয়ী হলেও দলটির ভোট এতটা নেই। প্রার্থী বদল করলে কিছুটা ভোট বাড়তে পারত।

শরিকেরা যা ভাবছে

১৪ দলের সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ আসলে উপনির্বাচনের মাধ্যমে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের দলীয় শক্তি দেখতে চেয়েছে। এ জন্যই আসন ছাড়লেও শরিকদের জয়ী করে আনার চেষ্টা করেনি। এর পেছনে কিছু কৌশল থাকতে পারে। যেমন দুটি আসনে শরিকেরা জিতলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তারা এই দুটি আসন নিশ্চিতভাবে চাইবে। এখন হারার ফলে দর-কষাকষি কমে যাবে।

শরিকদের সূত্র আরও জানিয়েছে, এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের জোট শরিকদের এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা কিংবা ২০১৮ সালের মতো হবে না। আওয়ামী লীগ চাইলে হয়তো শরিকদের সব স্থানে জিতিয়ে আনতে পারবে না। এ জন্য নিজেরা যাতে সংগঠিত হয়, এ জন্যই শরিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, উপনির্বাচন নিয়ে মূল্যায়ন করার জন্য আগামী বৃহস্পতিবার দলের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে দল ও জোটের কার কী ভূমিকা, ঘাটতি ছিল, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ার্কার্স পার্টির অবস্থান প্রকাশ করা হবে।