নির্বাচন ও বিএনপির এক দফার আন্দোলন লক্ষ্য রেখেই ৬ আগস্ট বিশেষ বর্ধিত সভা করছে আওয়ামী লীগ। প্রায় তিন হাজার নেতা অংশ নেবেন।
স্বল্প সময়ের নোটিশে দলের নেতা-কর্মীদের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজপথে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের আন্দোলন লক্ষ্য রেখেই এই প্রস্তুতি। এ জন্য আগামী ৬ আগস্ট আওয়ামী লীগের সারা দেশের সর্বস্তরের কমিটির শীর্ষ নেতাদের ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছে। ওই দিন গণভবনে বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে।
সর্বশেষ এ ধরনের বিশেষ বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। ২০১৭ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত ওই বর্ধিত সভার মূল বিষয় ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবার যোগ হয়েছে বিরোধী দলের এক দফার আন্দোলন।
বিশেষ বর্ধিত সভাকে দল খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। মূলত তৃণমূলের কথা শুনবেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। আবার তৃণমূলকে নির্দেশনা দেবেন তিনি। মূল লক্ষ্য আসন্ন নির্বাচন। ভোটে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে চাইলে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকবেআওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, বর্ধিত সভার মূল লক্ষ্য হচ্ছেন তৃণমূলের নেতারা। তাঁদের আগামী নির্বাচনের বিষয়ে আশ্বস্ত করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় প্রধানের বার্তা থাকবে—সংবিধান মেনে সময়মতো
দেশে নির্বাচন হবে। যত বাধা ও চাপ আসুক না কেন, পিছপা হবে না আওয়ামী লীগ। নেতা-কর্মীদের সেভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে নির্বাচনে কেউ হারাতে পারবে না—এই বার্তাও দেওয়া হবে। এর বাইরে থাকবে নির্দেশনা। যেমন বিরোধী দল ভোট ঠেকানো ও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাবে। তাই নেতা-কর্মীদের স্বল্প সময়ের নোটিশে যেকোনো কর্মসূচি পালন কিংবা রাজপথে অবস্থান নেওয়ার মতো প্রস্তুতি নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কিংবা বিরোধী দলের আন্দোলন—যেকোনো বিষয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দলে ঐক্য দরকার। কিন্তু তৃণমূলে অনেক জায়গায় দলীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই ধারায় বিভক্ত। সংসদ সদস্যের সঙ্গে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের বিভেদ প্রকট। একজনের সঙ্গে অন্যজনের মুখ-দেখাদেখি বন্ধ—এমনও রয়েছে অনেক এলাকায়। বিবদমান সবাইকে এক জায়গায় এনে ঐক্যের ডাক দেওয়া হবে। ওই নেতা আরও বলেন, এবার নির্বাচনে স্লোগান হবে—নৌকা যাঁর, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর। দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর পক্ষে একযোগে কাজ করার বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ বর্ধিত সভাকে দল খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। মূলত তৃণমূলের কথা শুনবেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। আবার তৃণমূলকে নির্দেশনা দেবেন তিনি। মূল লক্ষ্য আসন্ন নির্বাচন। ভোটে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে চাইলে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে।
দেশে নির্বাচন হবে। যত বাধা ও চাপ আসুক না কেন, পিছপা হবে না আওয়ামী লীগ। নেতা-কর্মীদের সেভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে নির্বাচনে কেউ হারাতে পারবে না—এই বার্তাও দেওয়া হবে।
লক্ষ্য নেতাদের উজ্জীবিত করা
আওয়ামী লীগের পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে বর্ধিত সভার গুরুত্ব নিয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের মূল কথা হচ্ছে, মার্কিন ভিসা নীতি, নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন কর্মসূচিতে বেশি বেশি লোক জমায়েতের চেষ্টা—এসব বিষয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে। জেলা, উপজেলা, এমনকি অনেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁরা ‘সামনে কী হবে?’ এমন প্রশ্নে করেন। তাঁদের কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ আছে।
ব্যক্তিগত আলাপে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরও অনেকে স্বীকার করেন, এবারের নির্বাচন অন্যান্যবারের তুলনায় ভিন্ন। এর ব্যাখ্যায় তাঁরা বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে। তবে সে সময় পরিস্থিতি সামলাতে দলের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর গুরুদায়িত্ব ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও দলকে এতটা প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু এবার দলকে গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। সহায়ক শক্তি হিসেবে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ জন্যই আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের ‘চাঙা’ করার উদ্যোগ নিয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে বিএনপির পাল্টা হিসেবে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা কাজে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার বাইরে নির্বাচনী সমাবেশ করবেন। এর মাধ্যমেও দলের নেতা-কর্মীরা আরও উজ্জীবিত হবেন বলে দলের নেতারা মনে করছেন।
একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। ঢাকায় বর্ধিত সভার মাধ্যমে বিভেদ কমানো এবং আশ্বস্ত করতে পারলে রাজপথে এর ফল পাওয়া যাবে। বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির কারণে এবার শোকের মাস আগস্টের কর্মসূচিতেও কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে শোকের কর্মসূচি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ে সীমাবদ্ধ থাকত। এবার সভা-সমাবেশে জোর দেওয়া হচ্ছে।
বর্ধিত সভায় যাঁরা থাকবেন
বর্ধিত সভাটি ৩০ জুলাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচন। ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রংপুরে সমাবেশ আছে। সব জেলা থেকে প্রতিনিধিদের আসা নিশ্চিত করতেই ৬ আগস্ট বর্ধিত সভার তারিখ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, বিশেষ বর্ধিত সভায় তিন হাজারের মতো দলের নেতা অংশ নিতে পারেন। তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে আগামী নির্বাচন ও বিরোধী দলের আন্দোলন সম্পর্কে বক্তব্য শোনা হবে। আর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরকারের উন্নয়ন-অর্জন প্রচারের জন্য বই, সিডিসহ বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হবে তৃণমূলের নেতাদের। তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে নির্বাচনের আগে এর প্রচার চালাবেন।
বর্ধিত সভায় দলের জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের সবাই অংশ নেবেন। জেলা/মহানগর এবং উপজেলা/থানা/পৌরসভার পর্যায়ের দলীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। একইভাবে সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা অংশ নেবেন সভায়। এ ছাড়া দলীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের দলীয় নির্বাচিত চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার দলীয় মেয়রদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের ভোটের আগে চাঙা করা মূল লক্ষ্য। এর মাধ্যমে দলের ঐক্যও সুদৃঢ় হবে। আর আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ হারাতে পারবে না।