নির্বাচন পর্যন্ত সরকারবিরোধী ভূমিকায় সক্রিয় থাকতে চায় জাতীয় পার্টির (জাপা) বড় একটি অংশ। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, জাপার সরকারবিরোধিতা অনেকটা মুখে মুখে। দলটির নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে থাকবে সরকারের সমালোচনা। তবে চূড়ান্তভাবে সরকারে বাইরের যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নেই জাপার। ইতিমধ্যে দলটি পরিষ্কার করেছে যে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সমর্থন করে না।
জাপার নেতারা বলছেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চেষ্টা হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং দলীয় অবস্থান ধরে রাখা। এ লক্ষ্যে আগামী দিনগুলোয় সরকারবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সভা-সমাবেশে সক্রিয় থাকবেন নেতারা। গতকাল রোববার জাপার কো-চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভায় অধিকাংশই এমন মতামত দেন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জি এম কাদের) দায়িত্ব পালনের ওপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় প্রায় চার মাস তিনি দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে ছিলেন। সে নিষেধাজ্ঞা আদালতে স্থগিত হওয়ার পর তিনি কিছুদিন ধরে দলীয় কর্মকাণ্ডে আবার সক্রিয় হয়েছেন। এখন লম্বা সময় পর গতকাল জি এম কাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ তিন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে এ যৌথ সভা করেন। এতে তিনি সভাপতিত্ব করেন। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ সভায় ছিলেন না। তবে তাঁর ছেলে সংসদ সদস্য রাহগীর আল মাহি (সাদ এরশাদ) উপস্থিত ছিলেন।
জাপার নেতারা বলছেন, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন নিয়ে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে করা মামলাটি আজ সোমবার আপিল বিভাগে শুনানির কথা রয়েছে। এর আগে দলের গুরুত্বপূর্ণ তিন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে এ যৌথ সভা করে কার্যত জি এম কাদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের সক্রিয়তার জানান দিতে চেয়েছেন। গত শুক্রবার ছিল জি এম কাদেরের জন্মদিন। এবার নেতা-কর্মীরা অনেকটা ঘটা করেই তাঁর জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন। রওশন এরশাদও জি এম কাদেরকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এগুলোকে দলে ঐক্যের আভাস মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক বলেন, ‘একটি সিভিল মামলার কারণে পার্টির চেয়ারম্যান অনেক দিন ধরে প্রেসিডিয়ামের সভা আহ্বান করতে পারেননি। কিছুদিন আগে মহামান্য হাইকোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করায় মাননীয় চেয়ারম্যান এখন মুক্ত। তাই একটি যৌথ সভার আয়োজন করা হয়েছে।’
তত্ত্বাবধায়ক চায় না জাপা
গতকালের যৌথ সভায় উপস্থিত ছিলেন—এমন একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, সভায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি; যদিও সভার পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তাঁদের বিশ্বাস সেই। সরকার চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে।
মুজিবুল হক বলেন, ‘আমরা কেয়ারটেকার সরকারের অধীন নির্বাচনে বিশ্বাস করি না। নির্বাচিতরা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে না পারলে কেয়ারটেকার সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে, তার গ্যারান্টি নেই। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকারের অধীন নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বক্তব্যে প্রমাণ করেছে, ওই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।’
দলীয় সূত্র জানায়, এ বক্তব্যের ইঙ্গিত হচ্ছে, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, সেটাকে জাপা সমর্থন করে না। এটা সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। জাতীয় পাটি যে চূড়ান্তভাবে সরকারের বাইরে অন্য কিছু ভাবছে না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জাপার অবস্থান তার ইঙ্গিত দেয়।
এ বিষয়ে জাপার কো–চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। বিরোধটা আসলে মুখে মুখে।’
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, শুধু মুখে নয় সত্যিকার অর্থে কাজে–কর্মে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে জাতীয় পার্টি।
অবশ্য দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, জাপার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাইরে একটি নতুন ফর্মুলা নিয়ে কাজ করছে। তাতে বর্তমান সরকার ও নির্বচন কমিশনের অধীন নির্বাচনের প্রস্তাবনা থাকবে। শিগগিরই তারা বর্তমান সংবিধানের আলোকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তাব দেবে।
এ বিষয়ে জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি, কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীন নির্বাচন হলে সে নির্বাচন কখনো নিরপেক্ষ হবে না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাইরে সংবিধানের ভেতরে থেকেই কিছু পরিবর্তন এনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি প্রস্তাব নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
জাপার একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গতকালের সভায় সরকারের পক্ষে দলীয় সংসদ সদস্যদের কারও কারও ভূমিকা রাখার বিষয়ে কথা তুলে সমালোচনা করেন কয়েকজন নেতা। তাঁরা বলেছেন, এতে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে গৃহপালিত বিরোধী দলের যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটি কাটছে না। তখন এর বিরোধিতাও করেন কাজী ফিরোজ রশীদসহ দু-একজন। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। বরং অতীতে যাঁরা একসঙ্গে সরকারের মন্ত্রী এবং বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের কারণেই দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।
প্রসঙ্গ মসিউর ও জিয়াউল হক
গতকালের সভায় সাবেক মহাসচিব ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা ও চেয়ারম্যানের সাবেক উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধার বিষয় নিয়ে দলটির একাধিক নেতা কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ দুই নেতা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা এবং অশালীন কথাবার্তা বলে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন। তাঁদের দলে ফেরানো যাবে না। তবে এ বিষয়ে চেয়ারম্যানই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
সভায় জানানো হয়, আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে নির্বাচনের আগে পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে। এখন চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া হবে। এ ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন করা, প্রতিটি বিভাগে একটি করে বড় সমাবেশ করার বিষয়ে আলোচনা ও মতামত দেন নেতারা।
জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার মাস পর মতবিনিময় সভা করেছি। সবাই একটি বিষয়ে একমত যে জাতীয় পার্টিকে তার নিজস্ব রাজনীতি করতে হবে। সরকারের দালালি করলে রাজনীতি থাকবে না।’