শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম হত্যার ৪৭ বছর পর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন তাঁর মেয়ে সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে গুলি চালিয়ে নাজমুল হুদাকে হত্যা করা হয়। মামলায় মেজর (অব.) আবদুল জলিলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এছাড়া তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা লে. কর্নেল আবু তাহেরকে (অব.) হুকুমের আসামি করা হয়েছে।
শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া আজ বৃহস্পতিবার মামলা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেজর (অব.) জলিলসহ অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। আসামিদের তিনজন ইতিপূর্বে মারা গেছেন। তবে ঘটনায় কার কী ভূমিকা ও সম্পৃক্ততা ছিল, তদন্তে সবই বেরিয়ে আসবে। তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
নাহিদ ইজাহার খান মামলায় বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও বিশৃঙ্খল সদস্যদের হাতে কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম নিহত হন। তিনি তখনকার সেনাবাহিনীর রংপুরের ৭২ ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। নাজমুল হুদার সঙ্গে অপর দুই সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমও নিহত হন।
মামলায় নাহিদ ইজাহার খান উল্লেখ করেন, তাঁর বাবা (নাজমুল হুদা) নিহত হওয়ার সময় তিনি ও তাঁর ভাই ছোট ছিলেন। তাঁরা বড় হয়ে বাবার কোর্সমেট, সহকর্মী ও বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুসন্ধানে জানতে পারেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসে (এখনকার জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেল) শহীদ কর্নেল নাজমুল হুদার সঙ্গে অপর দুই সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমও অবস্থান করছিলেন। নাজমুল হুদা সকালে নাশতা করার সময় দশম ইস্ট বেঙ্গলের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল নওয়াজেশের কাছে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে একটি ফোন আসে। এরপর দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তারা নাজমুল হুদাসহ তিন কর্মকর্তাকে বাইরে নিয়ে যান।
মামলার বিবরণে নাহিদ ইজাহার খান লিখেছেন, ১৯৭৫ সালে তখনকার সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা লে. কর্নেল আবু তাহেরের (অব.) নির্দেশে দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা, জেসিও ও সৈনিকেরা সংঘবদ্ধভাবে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিরাজ (তৎকালীন ক্যাপ্টেন), মেজর মুকতাদির (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা আরও জানতে পারেন, দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা, জেসিও এবং সৈনিকদের সঙ্গে মেজর মো. আসাদ উজ্জামান (অব.), মেজর মো. আবদুল জলিল (অব.) সাবেক তিন সেনা কর্মকর্তা নাজমুল হুদা, খালেদ মোশাররফ ও এ টি এম হায়দারকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে গুলি করার পর তাঁদের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয়।
নাহিদ ইজাহার খান মামলায় আরও উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাঁর বাবা (নাজমুল হুদা) সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ছিলেন যশোর ৮ নম্বর সেক্টরের বায়রা সাব–সেক্টর কমান্ডার। পরে দেশে তাঁদের জন্য সময়টা এতটাই প্রতিকূল ছিল যে একবার ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার কাছে তাঁর ভাই গিয়েছিলেন বাবার নামে রাস্তার নামকরণের জন্য। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রাস্তার নামকরণ করা হচ্ছিল। তিনি (সাদেক হোসেন খোকা) তাঁর ভাইয়ের আবেদনপত্র হাতে নিয়ে বাবার নাম দেখে তাঁকে অফিস কক্ষ থেকে বের করে দেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার ক্ষমতায়। দেশবাসী ন্যায়বিচার পাচ্ছে। তাই তিনি তাঁর বাবাসহ তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তা হত্যার বিচার দাবি করেছেন।
নাহিদ ইজাহার খান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য। হত্যাকাণ্ডের এত দিন পর কেন মামলা করলেন, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার হত্যাকাণ্ডের সময় আমাদের দুই ভাই-বোনের বয়স যথাক্রমে পাঁচ ও আট বছর। তখন পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। বাবার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তথ্যপ্রমাণ যতটুকু হাতে পেয়েছি, সে অনুযায়ী এখনই মামলা করার সঠিক সময় বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।’
এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমরা চাই, মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যার বিচার আইনানুগ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত স্বাধীনতার পক্ষের সরকার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। জাতির পিতা ও তাঁর স্বজনদের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী, মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যারও বিচার হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, রক্তের সিঁড়ি বেয়ে কেউ না আসুক এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা সবাই ন্যায়বিচার পাব, এটাই প্রত্যাশা করি।’