দুপুরে অনুমতি, বিকেলে ভরে গেছে মাঠ

২৭ দিন ধরে ১২ মাঠ নিয়ে প্রস্তাব, পাল্টাপ্রস্তাব শেষে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি পায় বিএনপি।

সমাবেশস্থলে জড়ো হওয়া বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের একাংশ। গতকাল বিকেলে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে

একজনের প্রাণহানি, মহাসচিবসহ চার শতাধিক নেতা–কর্মীর গ্রেপ্তার, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তছনছ, গত তিন দিনে এমন উত্তাপ ছড়ানো অনেক ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার ঢাকায় সমাবেশের জায়গা পেয়েছে বিএনপি। এর আগে অন্তত ১২টি মাঠ নিয়ে প্রস্তাব, পাল্টাপ্রস্তাব দিয়েছিল পুলিশ ও বিএনপি। আগের দিন এসে গোলাপবাগ মাঠের অনুমতি পায় এবং সেখানেই আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলটির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ।

গতকাল বেলা দুইটার দিকে পুলিশ গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি দেয়। বেলা সাড়ে তিনটায় বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘোষণা দেয়। এর এক ঘণ্টার মধ্যেই বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কাছে ওই মাঠে জড়ো হতে থাকেন। সন্ধ্যার মধ্যেই মাঠ ভরে যায়। রাতেই শুরু হয় মঞ্চ নির্মাণসহ অন্যান্য প্রস্তুতি।

এর আগে সমাবেশ নয়াপল্টন নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এই নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার মধ্যেই গত বুধবার নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে মকবুল হোসেন নামের স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা নিহত হন। সেই থেকে নয়াপল্টন এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও তালাবদ্ধ রাখে। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পুরো নয়াপল্টন এলাকায় মানুষের চলাচলই বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এমন একটা অবস্থায় সমাবেশ নিয়ে অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়। এর মধ্যেই সন্ধ্যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে নতুন করে স্থান নিয়ে বৈঠক করে। তার আগে পুলিশ নয়াপল্টনের রাস্তা খুলে দেয়। সমঝোতার নতুন একটা আভাস দেখা দেয়। ওই বৈঠক শেষে খবর বের হয়, বিএনপি কমলাপুর স্টেডিয়াম এবং পুলিশ মিরপুরের বাঙলা কলেজের মাঠে সমাবেশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। উভয় পক্ষ সরেজমিন পরিদর্শন করে পরদিন সিদ্ধান্ত জানাবে, এমন কথা হয়।

আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে মির্জা ফখরুল ইসলাম ও মির্জা আব্বাসকে। গতকাল সিএমএম কোর্ট প্রাঙ্গণে

এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে একযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে মির্জা আব্বাস কমলাপুর স্টেডিয়াম, বাঙলা কলেজ মাঠ ও গোলাপবাগ মাঠ পরিদর্শন শেষে বাসায় ফিরেই আটক হন। ফলে সমাবেশের স্থান নিয়ে আরেক দফা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। গতকাল বেলা ১১টার দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, কমলাপুর স্টেডিয়াম দেওয়া হবে না, বিএনপিকে সমাবেশ করতে হলে মিরপুরে বাঙলা কলেজের মাঠেই যেতে হবে। এরপর সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে গতকাল দুপুরে বিএনপি নতুন করে উদ্যোগ নেয়। দলের ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামালকে পাঠায় ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে আলোচনার জন্য। তাঁরা দলের পক্ষ থেকে কমলাপুর স্টেডিয়ামের পরিবর্তে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে নতুন আবেদন করেন। পাশাপাশি দলের স্থায়ী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত জানাতে বেলা তিনটায় সংবাদ সম্মেলনেরও ঘোষণা দেন। পরে ওই সংবাদ সম্মেলনেই গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার তথ্য জানানো হয়।

বিএনপির গত নয়টি বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম। ঢাকার এই সমাবেশেও তাঁর প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল। এই গণসমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হলেন সাবেক মন্ত্রী ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এখন তাঁদের অনুপস্থিতিতেই সমাবেশ হচ্ছে।

অবশ্য গতকাল বিকেলে গুলশানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এটা এখন আর দলীয় কোনো সমাবেশ নয়। আমরা অতীতের সমাবেশগুলোতে দেখেছি, এটা হচ্ছে জনগণের সমাবেশ। তাই আমরা কে থাকলাম, কে থাকলাম না, এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, সমাবেশটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রধান অতিথি, প্রধান উপদেষ্টা সমাবেশে না থাকতে পারলেও জনগণের সমাবেশ জনগণই সাফল্যমণ্ডিত করবে।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, আগের নয়টি বিভাগীয় গণসমাবেশে মানুষের উপস্থিতি দেখে ঢাকার সমাবেশ ঘিরে সরকারের মধ্যে ভয় ঢুকেছে। সে জন্য সমাবেশের তিন দিন আগে নয়াপল্টনে পুলিশকে দিয়ে নেতা–কর্মীদের ওপর আক্রমণ, কার্যালয়ে অভিযান, ঢাকার প্রবেশমুখে তল্লাশিচৌকি বসানো এবং চার শতাধিক নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তারের পর শেষ মুহূর্তে দলের মহাসচিবকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এই সবকিছুর মূল লক্ষ্য গণসমাবেশে উপস্থিতি কমানো।

ঢাকার এই গণসমাবেশ নিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা চলছিল। নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ২৭ দিন আগে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করে বিএনপি। কিন্তু পুলিশ ২৬টি শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিলে বিএনপি সেখানে যেতে অসম্মতি জানায়। পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর বিএনপি নয়াপল্টনে অনড় থাকে। এ নিয়ে দুই পক্ষের আলোচনায় বিকল্প হিসেবে টঙ্গী ইজতেমা মাঠ, পূর্বাচলের বাণিজ্য মেলার মাঠ, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুরের কালশী, বাঙলা কলেজ মাঠ, কমলাপুর স্টেডিয়াম, জাতীয় ঈদগাহ, আরামবাগ, সেন্ট্রাল মডেল স্কুল মাঠ, খিলগাঁও জোড়াপুকুর মাঠের নাম আসে। শেষ সময়ে গোলাপবাগ মাঠে সম্মত হয় উভয় পক্ষ। সোহরাওয়ার্দীর মতো এখানেও পুলিশ ২৬ শর্ত দিয়েছে।

মহাসচিবকে গ্রেপ্তারের পর চাপে ফেলে সরকার বিএনপিকে সমাবেশের জন্য গোলাপবাগ মাঠ দিল কি না, গতকাল সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পুলিশ বা পুলিশ কমিশনার এই স্থান আমাদের দেয়নি। এটা আমাদের প্রস্তাবিত স্থান। অর্থাৎ আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি, তারা এতে সম্মতি দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দল যেভাবে পাড়া–মহল্লায় মহড়া দিচ্ছে, সমাবেশ ঘিরে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার সম্পূর্ণভাবে সরকারকে বহন করতে হবে।

গণসমাবেশে বিএনপি কী বার্তা দেবে, সে বিষয়ে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন—এসব দাবিতে কিন্তু আমরা সমাবেশগুলো করছি। কালকে এটারই সমাবেশ। এই সমাবেশ থেকে আমরা আগামী দিনে এই সরকারের বিদায়ের জন্য কতগুলো চার্টার অব ডিমান্ড ঘোষণা করব।’

আজকের গণসমাবেশ থেকে অবাধ নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করা হবে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়। একই সঙ্গে এই ১০ দফা আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই আন্দোলনে যুগপৎভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য হয়েছে, এমন সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই স্বৈরাচারী সরকার গায়ের জোরে টিকে থাকার জন্য যে অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তার প্রতিবাদ এবং জবাব দেওয়ার জন্য ঢাকাবাসীকে আহ্বান জানাব।’