সিটি নির্বাচন

গাজীপুরে ভোটের প্রচারে আলোচনায় ‘ছদ্মবেশী’ কর্মী-সমর্থকেরা

গাজীপুর সিটি নির্বাচন
গাজীপুর সিটি নির্বাচন

বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও গাজীপুরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন ‘ছদ্মবেশী’ কর্মী-সমর্থকেরা। তাঁদের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন সাবেক কাউন্সিলরও রয়েছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, দলীয় ‘চাপের’ কারণে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী–সমর্থকদের একটি অংশ আজমত উল্লার পক্ষে এখন প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। বিএনপি ভোটে না থাকায় জাহাঙ্গীরের মা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকেই এবার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হচ্ছে। যে কারণে ‘ছদ্মবেশী’ কর্মী-সর্মথকদের বিষয়টি ভোটের আলোচনায় আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে।

আজমতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী আলিমুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কার মনে কী আছে, সেটা তো বোঝা সম্ভব না। কেউ কেউ জাহাঙ্গীরের পক্ষে থাকতে পারেন। তবে যাঁরা প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, তাঁরা দলের পক্ষে আছেন, থাকবেন।’

গাজীপুর সিটির নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে ২৫ মে। ভোটের প্রচার নিয়ে গতকাল রোববার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী প্রতিনিধি, সাধারণ ভোটারসহ ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের বক্তব্যের মূল কথা হচ্ছে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচনে নানা হিসাব–নিকাশ থাকে।

দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও এখানে কাজ করে। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শ্রমিকনেতা ও হেফাজত নেতাদের সঙ্গে সব সময় সখ্য রেখেছেন জাহাঙ্গীর। তাঁদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী প্রকাশ্যে আজমত উল্লার জন্য কাজ করলেও গোপনে তাঁরা জাহাঙ্গীরের কর্মী-সমর্থক।

‘ছদ্মবেশীদের’ নিয়ে আলোচনা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয় জাহাঙ্গীর আলমকে। তবে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও জাহাঙ্গীর নেতা-কর্মীদের একটি অংশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে ২০২২ সালের জুন মাসে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেয় গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ। নোটিশে সই ছিল গাজীপুর মহানগর কমিটির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডলের। তিনি এখন কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন।

ওই সময় গাজীপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ছিলেন মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান। এখনো তিনি একই পদে রয়েছেন।

নোটিশ পাওয়া নেতাদের মধ্যে ১৯ জন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে বিভিন্ন পদে ছিলেন। অন্যরা নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কমিটিতে থাকা নেতা-কর্মী। দল থেকে চাপ থাকায় এই নেতা-কর্মীদের অনেকে এখন আজমতের পক্ষে ভোটের মাঠে নেমেছেন। তবে প্রকাশ্যে মাঠে নামলেও তাঁরা জাহাঙ্গীরের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁদের অনেকের ক্ষোভ কাটেনি।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়েছে গত বছরের ১৯ নভেম্বর। সম্মেলনের ছয় মাস পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। এর আগের কমিটিতে জাহাঙ্গীর আলম সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন।

জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শোকজ পাওয়া নেতাদের মধ্যে প্রায় সবাই আগের কমিটির বিভিন্ন পদে ছিলেন। এখন ওই কমিটিও নেই আর নেতারা কোনো পদেও নেই। সব ভুলে গিয়ে এখন দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই আমরা আছি।’

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছিল আওয়ামী লীগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মার্চ জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে পুনর্বহাল করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন ৬১ জন কাউন্সিলর। এই কাউন্সিলরদেরও তখন কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এখন তাঁদের প্রায় সবাই নির্বাচনের মাঠে আছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা সবাই আজমত উল্লাহর পক্ষে কাজ করবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর নিজের এবং বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে দিয়ে মহানগরের সব কমিটি করেছিলেন। গাজীপুর আওয়ামী লীগকে কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা ছিল। একবারে তাঁদের সবাইকে বের করে দেওয়া সম্ভব হয়নি, আস্তে আস্তে পরিষ্কার করা হচ্ছে।

চিন্তার বিষয় ‘জায়েদা খাতুন’

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মেয়র পদে এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। দল মনোনয়ন দেয় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানকে। দলের ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে মেয়র পদে প্রার্থী হলেও যাচাই-বাছাইয়ে জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।

তবে জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়। টেবিলঘড়ি মার্কার প্রার্থী জায়েদা খাতুনের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীর আলম। মায়ের পক্ষে নির্বাচনের মাঠে নামায় জাহাঙ্গীরকে ১৫ মে আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা নিজের নির্বাচনী প্রচারে যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তার অনেকটা জুড়েই থাকছে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে। জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়েই তিনি এসব বক্তব্য দিচ্ছেন।

অন্যদিকে জায়েদা খাতুনের প্রচার পুরোটাই ছেলে জাহাঙ্গীরকেন্দ্রিক। ছাদখোলা গাড়িতে প্রচারে নামা জায়েদা খাতুন সামনের আসনে বসে থাকেন আর ছেলে জাহাঙ্গীর গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়েন। প্রচারে মায়ের হয়ে বক্তব্যও দেন তিনি।

আজমত উল্লা খানের নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়কারী ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়র পদে যাঁরা নির্বাচন করছেন, তাঁদের সবাইকেই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছি। কাউকেই ছোট করে দেখা যাবে না। টেবিলঘড়ির প্রার্থী (জায়েদা খাতুন) নারী ও একটু বয়স্ক মানুষ হওয়ায় তাঁর প্রতি মানুষের সিম্প্যাথি (সহানুভূতি) কাজ করতে পারে। যার কারণে তাঁর বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’

প্রচারের শেষ সময়ে এসে জায়েদা খাতুনকে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। অভিযোগের তির আওয়ামী লীগ প্রার্থীর দিকে। গত চার দিনে জায়েদা খাতুনের জনসংযোগে দুবার হামলার অভিযোগ ওঠে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টঙ্গীর পূর্ব গোপালপুর এলাকায় জায়েদা খাতুনের জনসংযোগের সময় হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর শনিবার বিকেলে টঙ্গী পূর্ব বউবাজার এলাকায় হামলা হয়। এ সময় গণসংযোগে ব্যবহৃত গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

গত শনিবার রাতে নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে জায়েদা খাতুন বলেন, ‘যতই মারামারি করুক, আমি মাঠ ছাড়ব না।’

টঙ্গীর ভোট নিয়েও আলোচনা

বিএনপি ভোটে না থাকলেও দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনুর ইসলাম গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। হাসান উদ্দিন সরকার গাজীপুর সিটির গত নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন। শাহনুরের পরিবারের রাজনীতি টঙ্গীকেন্দ্রিক। তিনি টঙ্গীতে প্রচারে জোর দিচ্ছেন।

গাজীপুর সিটির গত নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হাতপাখা প্রতীকে প্রায় ২৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এবার মেয়র নির্বাচনে দলের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমানের এলাকাও টঙ্গী। আজমত উল্লা ও আতাউর রহমান একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আতাউর নির্বাচনী প্রচারে টঙ্গীকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান দীর্ঘ ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন।

আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য জাহাঙ্গীর আলম এবার কতটা চিন্তার কারণ হবেন, সে বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির প্রথম আলোকে বলেন, নিজেকে জনপ্রিয় করতে এর আগে জাহাঙ্গীর কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সেটি সফলও হয়েছিল। বিভিন্ন জনকে দান–অনুদান এবং আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কৌশল খাটিয়েছিলেন তিনি। এতে তরুণদের একটি অংশকে তিনি আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আবার জাহাঙ্গীর নিজেও প্রার্থী হতে পারেননি। ফলে তাঁর পুরোনো কৌশল কতটা কাজে লাগবে, তা জানতে ভোটের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।