ছাত্ররাজনীতি
ছাত্ররাজনীতি

৩৩ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ

শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দেশের অন্তত ১৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি সরকারি কলেজ ও ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে ২৭টিতে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নির্যাতনসহ নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্ররাজনীতি চালু থাকলে আবারও ক্যাম্পাসে একই অবস্থা তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের অনেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলছেন।

আমরা ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চাই না। আমাদের চাওয়া, ছাত্র সংসদভিত্তিক গঠনমূলক রাজনীতি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ডুয়েট ও জাককানইবি ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া মেডিকেল কলেজগুলো হলো—ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ ও রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ হয়েছে।

অন্তত চারটি সরকারি কলেজের প্রশাসনও ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এগুলো হলো— ইডেন মহিলা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ও বগুড়ার সান্তাহার সরকারি কলেজ। সান্তাহার কলেজে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের রাজনীতিসচেতন হিসেবে গড়ে তুলতে অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন আছে।
বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাগীব নাঈম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ

রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবিটি তুলনামূলক জোরালো ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে সিন্ডিকেটের এক সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির সমন্বয়কদের প্রায় সবাই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামের একটি ছাত্রসংগঠনের নেতা ছিলেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের গণমাধ্যমে যে ৯ দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন, তার ৭ নম্বর দাবিটি ছিল, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদ কার্যকর করা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চাই না। আমাদের চাওয়া, ছাত্র সংসদভিত্তিক গঠনমূলক রাজনীতি।’

এদিকে বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাগীব নাঈম বলছেন, শিক্ষার্থীদের রাজনীতিসচেতন হিসেবে গড়ে তুলতে অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্ররাজনীতির নামে দখলদারি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি বিরাজনৈতিকীকরণের চেষ্টা।

প্রস্তাব ও জরিপ

৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে (ডুজা) সংবাদ সম্মেলন করে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে আট দফা প্রস্তাব তুলে ধরে ইউনিভার্সিটি রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইউআরআই) নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। সেখানে যে দুজন শিক্ষার্থী লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, তাঁদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রী রাফিয়া রেহনুমা হৃদি। রাফিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দলনের অন্যতম সমন্বয়ক।

ইউআরআই নামের ওই প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে যে আট দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক স্থান ও একাডেমিক স্থানে সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি (সভা-সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, সম্মেলন, শোভাযাত্রা, শোডাউন প্রভৃতি) নিষিদ্ধ করা হবে; কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিচয় বা সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উল্লিখিত স্থানগুলোতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, কোনো সুযোগ-সুবিধা আদায় বা বিশেষ বিবেচনা লাভের প্রচেষ্টা চালাতে পারবে না; কোনো শিক্ষার্থী যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়, তবে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে, এ বিষয়ে সিন্ডিকেটে আইন পাস করতে হবে; উল্লিখিত স্থানগুলোয় কোনো দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত পরিসরে কেউ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করলে বা নিজস্ব মত প্রকাশ করলে তাকে কোনো শাস্তির আওতাভুক্ত করা হবে না।

এদিকে গত মঙ্গলবার বিকেলে ডুজা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক কার্যক্রম বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অভিমত’ শীর্ষক জরিপের ফল প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ (ডিইউআরএস)। এতে জানানো হয়, তাদের জরিপটি ৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১১ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৭৮টি বিভাগ ও ১০টি ইনস্টিটিউটের ২ হাজার ২৩৭ শিক্ষার্থী অংশ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এই জরিপে অংশ নিয়েছেন।

জরিপের ফলাফল বলছে, ৮৩ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী দলীয় ছাত্ররাজনীতি ‘একেবারেই নিষিদ্ধ’ চেয়েছেন। সংস্কারকৃত রূপে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি প্রত্যাশা করেছেন ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থাতেই প্রত্যাশা করেছেন শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্ররাজনীতির ‘কোনো গুরুত্ব নেই’ বলে মত দিয়েছেন।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ডিইউআরএসের পক্ষ থেকে চারটি সুপারিশও তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এগুলো হলো দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ডাকসুকে পুনরুজ্জীবিত ও সংস্কার করা, শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন কমিটি গঠন এবং শিক্ষা ও গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।