আ.লীগের সম্মেলন

কারও লক্ষ্য টিকে থাকা, কারও লক্ষ্য পদপ্রাপ্তি

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন,বিএনপি কীভাবে আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে।

আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মূল মঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে নৌকার আদলে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

আওয়ামী লীগের পদপ্রত্যাশীদের উৎকণ্ঠার শেষ হচ্ছে আগামীকাল শনিবার। সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে আলোচনা বেশি হলেও অন্য পদপ্রত্যাশী নেতারা বসে নেই। এর মধ্যে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা আগামী কমিটিতেও টিকে থাকতে যেমন চেষ্টা করছেন, কমিটির বাইরে থাকা নেতারাও জোর চেষ্টায় আছেন কোনো না কোনো পদ পাওয়ার জন্য।

আগামীকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। উদ্বোধনী পর্বের পর বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে দ্বিতীয় অধিবেশন বসবে। এর আগে দেখা গেছে, সম্মেলনে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ পদে নেতাদের নাম ঘোষণা করা হয়। ৮১ সদস্যের কমিটির কিছু কিছু পদ পরে পূরণ করা হয়।

আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, দলের একটি অংশ চায়, বর্তমান কমিটিতে বড় পরিবর্তন না হোক। কারণ হিসেবে তাঁরা বিরোধীদের আন্দোলন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ সামনে আনছেন। অন্য পক্ষ বলছে, সাধারণ সম্পাদকসহ দৈনন্দিন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত নেতারা দীর্ঘদিন একই পদে আছেন। পরিবর্তন এলে দলীয় কর্মকাণ্ডে নতুন চিন্তাভাবনা যোগ হবে। অবশ্য তাঁরা প্রকাশ্যে পরিবর্তনের বিষয়ে কথা বলছেন না।

আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এবারের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোভাবও একই কি না, সেটা পরিষ্কার নয়। এখনো তিনি সাধারণ সম্পাদক কিংবা অন্যান্য পদে পরিবর্তন, সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেননি। পরিবর্তন চান এমন নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগের সব সম্মেলনেই কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।

দলীয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রতিবারই সম্মেলনের আগে পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ কিছু নেতার সঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। তবে এবার সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহী বেশি হওয়ায় কমিটির নেতাদের সঙ্গে খুব একটা আলোচনা হয়নি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি একধরনের সলাপরামর্শ করেছেন।

কেন্দ্রীয় কমিটির চার নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্মেলন সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ পরিবারের সদস্যরা এখন ঢাকায়। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ অন্তত সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসছে কি না, তার কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।

সম্মেলন ঘিরে সভাপতিমণ্ডলীর চার-পাঁচজন এবং যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকেরা প্রায় দুই মাস ধরে দলীয় প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। সম্পাদকীয় পদের চার-পাঁচজন নেতাকে সারা বছরই তৎপর দেখা যায়। তাঁরা নিজেদের পদ নিয়ে নির্ভার। তবে কেউ কেউ পদোন্নতির আশায় আছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ সম্পাদক থেকে নির্বাহী সদস্য—কোনো পদেরই গুরুত্ব কম নয়। যাঁরা সাধারণ সম্পাদক হতে চান, তাঁরা যেমন দলীয় সভাপতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, তেমনি যাঁরা সদস্য পদে আছেন বা নতুন করে আসতে চান, তাঁরাও দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। গতকাল রাতে গণভবনে দলের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে অনেকে বক্তৃতা দেওয়ার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন বেশি। কাউকে গুরুত্ব দিলেন কি না, হাসি দিয়ে কারও সঙ্গে কথা বললেন কি না, কারও প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করলেন কি না—এগুলো সুনজর বা বিরক্তির চিহ্ন হিসেবে দেখেন নেতারা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, বড় দল, নেতা-কর্মী বেশি। ফলে সম্মেলন নিয়ে আগ্রহ থাকবেই। দলের সভাপতি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি যাঁকে দরকার মনে করবেন, তাঁকে যোগ্যতা অনুযায়ী পদ দেবেন।

সম্মেলনে বড় পরিবর্তন হবে না

দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনস্থল পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেন, এবার সম্মেলনে কমিটিতে তেমন একটা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রয়োজনে পরবর্তী সম্মেলন নির্বাচনের পর আগামও করতে পারি। তখন একটা বড় ধরনের পরিবর্তন হয়তো হবে।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, সবার দৃষ্টি দলের সাধারণ সম্পাদক পদের দিকে। এ পদে প্রার্থীদের অনেকের ইচ্ছা থাকতে পারে। অন্তত গণতান্ত্রিক দল হিসেবে। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, এই পদে অন্তত ১০ জন প্রার্থী আছেন। কে হবেন, এটা নেত্রীর ইচ্ছা এবং কাউন্সিলরদের মতামতের ওপর নির্ভর করছে। সবকিছু প্রতিফলন ঘটবে দ্বিতীয় অধিবেশনে। কাজেই আমি কারও নাম বলতে পারব না।’

বর্তমান কমিটির বিদায়ী সভা

গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদের সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা মুলতবি করে কাল শনিবার নেতৃত্ব নির্বাচনের দ্বিতীয় অধিবেশনে পুনরায় সভা বসবে।

দলীয় সূত্র জানায়, গতকাল বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন ও ঘোষণাপত্র অনুমোদন করা। এবারের ঘোষণাপত্রের স্লোগান ঠিক করা হয়েছে। সেটা হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। এর মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার কী কী থাকবে, সেটার আলোকপাত করা হয়েছে।

ফরিদপুর ও কুমিল্লা দুটি নতুন বিভাগ হবে—এ বিবেচনায় আওয়ামী লীগে আরও দুটি সাংগঠনিক সম্পাদক ও একটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ বাড়ানো যায় কি না, সেই আলোচনাও হয়েছে। তবে কমিটির সদস্যসংখ্যা না বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া জেলা পর্যায়ের সম্মেলনের পর ৪৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও গঠনতন্ত্রে যুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিএনপি কীভাবে আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে: প্রধানমন্ত্রী

বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা গতকাল বলেছেন, বিএনপি কীভাবে আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে।

গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সভাপতিত্বকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি কি দেশ ও জনগণের জন্য ভালো কোনো কিছু করছে, যার মাধ্যমে তারা তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে তুলবে যে কারণে জনগণ তাদের দলকে আবার ক্ষমতায় বসাবে।

তিনি বলেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, জিয়াউর রহমান দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পর থেকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রহসনমূলক হ্যাঁ/না ভোট এবং সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কঠোর সমালোচনা করে তাঁদের ‘বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রতিবন্ধী বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, তাঁরা একটি অগণতান্ত্রিক বা অবৈধ সরকার আনার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক বা আইনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছেন। ‘যাদের বিবেক ও মানবতাবোধ আছে, তারা কীভাবে অগ্নিসংযোগকারী সন্ত্রাসীদের সমর্থন করে’— তিনি এই প্রশ্ন করেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফর উল্যাহ প্রমুখ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

২৪ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগ ও যুব মহিলা লীগের নবনির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।