আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘খেলা হবে।’ কয়েক দিন না যেতেই ‘খেলা’ শুরু হয়ে গেছে।
এত দিন আমরা জানতাম রাজনীতির খেলাটা মাঠেই হয়। সরকারি ও বিরোধী দল নিজেদের শক্তি ও জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে বড় বড় জনসভা করে। জনসভা থেকে প্রতিপক্ষের দোষত্রুটি তুলে ধরার পাশাপাশি নিজেদের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু এবার দেখছি, খেলাটা মাঠে হচ্ছে না। খেলাটা হচ্ছে প্রতিপক্ষের বাড়িতে, অফিসে অথবা যেখানে তারা পারছে।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দুই দলীয় কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। কিন্তু সেই কর্মসূচি পালনের সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর লক্ষ্মীপুরের পুরোনো গোহাটা এলাকার বাসায় গত সোমবার হামলা চালানো হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা কবির পাটোয়ারীর নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এই হামলা চালান বলে অভিযোগ। এতে বিএনপির নেতার ভাই আরিফ চৌধুরী, ছেলে সাহরিয়ান চৌধুরী ও বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আহত হন।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর বাড়িতে যখন হামলার ঘটনা ঘটে, তখন তিনি সদর উপজেলায় আয়োজিত এক সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হামলাকারীরা জানতেন যে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বাড়িতে নেই। তারপরও সেখানে হামলা করা কাপুরুষোচিত।
বরিশালের গৌরনদীর ঘটনা আরও চমকপ্রদ। সেখানে বিএনপি প্রতিবাদ কর্মসূচি ডাকতে পারে—এই খবর পেয়েই সোমবার স্থানীয় যুবদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়। সেখানেও হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ঘটনায় আহত চারজনকে বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জামালপুরের মাদারগঞ্জে বিএনপি সোমবার বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করলে সেখানেও হামলা চালান আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ বানচাল করতে আওয়ামী লীগ দ্বিমুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। এক. বিএনপির নেতার বাড়িতে, অফিসে কিংবা সমাবেশস্থলে হামলা করা। দুই. যেখানে বিএনপি সমাবেশ ডেকেছে, সেখানে কর্মসূচি ঘোষণা করে গোলযোগ বাধানো।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
বরগুনার তালতলী, পটুয়াখালীর দুমকি, ফেনীর পরশুরামে গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একই স্থানে একই সময়ে কর্মসূচি ঘোষণা করায় উপজেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু তারা তলিয়ে দেখল না, কারা আগে কর্মসূচি নিয়েছে, কারা প্রতিপক্ষের সমাবেশ বানচাল করতে চাইছে।
সংশ্লিষ্ট এলাকায় কি জায়গার অভাব আছে যে একই সময় একই স্থানে আওয়ামী লীগকে কর্মসূচি দিতে হবে? একে বলে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া লাগানো। তবে আওয়ামী লীগ পায়ে-পায়ে ঝগড়া লাগানোর পাশাপাশি হাতও চালিয়ে কয়েকজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে।
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বললেন, বিরোধী দল সভা–সমাবেশ করতে পারবে, বাধা দেওয়া হবে না, কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না; তখন দেশবাসী কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে যে তাহলে দেশে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে। এমনকি শেখ হাসিনা এও ঘোষণা করেছিলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা যদি গণভবন ঘেরাও করতে আসেন, তাঁদের বাধা দেওয়া হবে না।
অবশ্য এরপরই ভোলায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ এবং গুলিতে দুজন কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটল।
বরগুনায় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের পেটানোর ঘটনায় সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্তের আগেই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অথচ ভোলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপির যে দুই কর্মী মারা গেলেন, সেখানে কারও বাড়াবাড়ি খুঁজে পায়নি সরকার। এতে প্রমাণিত হলো গুলিতে মারা যাওয়ার চেয়ে লাঠিপেটা গুরুতর অপরাধ। কার গুলিতে কে মারা গেছেন, কিংবা কার লাঠির আঘাতে কে জখম হয়েছেন, সেটি বড় নয়। বড় হলো নিহত বা আহত ব্যক্তি কোন দলের।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর বাকি। তারপরও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা যে বিএনপিকে খেলা হবে বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, এখন দেখা যাচ্ছে তাঁরা নিজেরাই খেলার নিয়ম মানছেন না। মাঠের খেলাকে বিরোধী দলের নেতাদের বাড়িতে নিয়ে গেছেন।