ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে ভোটকক্ষের ‘ডাকাত’ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ভোটার ও তিন প্রার্থী। এই আসনের ৮২৬টি ভোটকক্ষের কোনোটিতেই ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) থাকছে না। অন্যদিকে উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জেতাতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। ফলে ভোটাররা নিজের ভোট দিতে পারা নিয়ে সন্দেহ করছেন৷
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া বিজয়ী হয়েছিলেন। গত ১১ ডিসেম্বর তিনি দলীয় সিদ্ধান্তে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় আসনটি শূন্য হয়। আগামীকাল বুধবার এই আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ভোটকক্ষের 'ডাকাত' শব্দটি বেশি আলোচনায় আসে গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনের কারণে। ভোট শুরুর পর নানা অনিয়মের অভিযোগে ওই উপনির্বাচনের ভোট বন্ধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, 'গোপন কক্ষে অনুপ্রবেশকারীরাই ভোটকেন্দ্রের ডাকাত। এরাই দুর্বৃত্ত। যারা আইন মানে না, তাদেরই আমরা ডাকাত বলতে পারি, দুর্বৃত্ত বলতে পারি।’
আজ মঙ্গলবার সকালে সরাইল উপজেলা সদরের হাসপাতাল মোড় বাজার ও কালিকচ্ছ ইউনিয়নের কালিবাজারে গিয়ে সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা হয়। প্রায় সব ভোটারই ভোটের দিন পরিবেশ কেমন থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
নির্বাচনী মাঠে আছেন চার প্রার্থী। তাঁরা হলেন, আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া (কলার ছড়া), আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ (মোটরগাড়ি), জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী (লাঙ্গল) ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম (গোলাপ ফুল)।
সদরের বেপারি পাড়া গ্রামের বাসিন্দা সোহেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, 'আগে কেন্দ্রের পরিস্থিতি দেখব। পরিবেশ ভালো দেখলে ভোট দেব। সবাই যেমনে বলতেসে কেন্দ্রে গিয়েও ভোট দেওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।'
সাত্তারের বিরোধী প্রার্থীর লোকজন ও ভোটাররা বলছেন, আওয়ামী লীগের লোকজন কলার ছড়ায় (সাত্তারের প্রতীক) ভোট নেবে বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছে। সিসি ক্যামেরা না থাকায় ভোটকক্ষে কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গেলেও নিজের ভোট দিতে পারা নিয়ে শঙ্কিত। ভোটকক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির উপস্থিতি থাকবে বলেও তাদের ধারণা।
জাপার প্রার্থী আবদুল হামিদ ভাসানী প্রথম আলোকে বলেন, 'বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছি ভোটাররা ইভিএমে ফিঙ্গার দেওয়ার পর তাদের প্রার্থীর প্রতীকে চাপ দিতে দেওয়া হবে না৷ কলার ছড়ার পক্ষে ভোট নিতে বলপ্রয়োগ করা হবে৷ এমন পরিস্থিতি করা হলে ভোট আয়োজনের কী দরকার ছিল।' তিনি বলেন, ভোটগ্রহণ শুরুর পর পরিস্থিতি দেখে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানাবেন৷
উকিল সাত্তারের নির্বাচনী প্রচারে সরব ছিলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। নিজ দলের প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করিয়েই তাঁরা ক্ষান্ত হননি। দ্বন্দ্ব-বিভক্তি ভুলে সাত্তারের পক্ষে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সাত্তারের নির্বাচনী এজেন্টও হচ্ছেন তাঁরা। সাত্তারের একতরফা জয় নিশ্চিতে নির্বাচনে থাকা অন্য তিন প্রার্থীকে একরকম নির্বাচন থেকে 'সরিয়ে দেওয়া' হয়েছে।
ভোটার ও প্রার্থীদের শঙ্কা তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরাইল উপজেলার সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম মিলনায়তনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার সমর্থনে অনুষ্ঠিত আলোচনা ও পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপনির্বাচনে জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দায়িত্বকে দুটি ভাগে ভাগ করার কথা জানিয়ে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার।
আল মামুন সরকার বলেন, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। কলার ছড়া প্রতীকে ভোট নেওয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের। যাঁরা সরকারের বিভিন্ন সুবিধা পান, জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ভোটকেন্দ্রে হাজির করাবেন।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও স্বজনদের ভোটকেন্দ্রে সাত্তারের নির্বাচনী এজেন্ট করা হচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যারা পদে আছেন তাদের সমন্বয়ে এজেন্ট নিয়োগ কমিটি করা হয়েছে৷ ফলে ভোটকক্ষে আওয়ামী লীগের লোকজন উপস্থিত থাকবেন।
আশুগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাহীন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, এখানে দলীয় কোনো প্রার্থী নেই। আওয়ামী লীগ আবদুস সাত্তারকে সমর্থন দিয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরা ভোটকেন্দ্রে ওনার এজেন্ট হবে।
ভোটাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা সাত্তারকে জেতাতে মরিয়া। তাই নির্বাচনের ফল সাত্তারের পক্ষেই যাবে, এটা সবাই বুঝতে পারছেন।
সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৯ জন। মোট ১৩২টি কেন্দ্র ও ৮২৬টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ হবে। সব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে ইভিএম মেশিনে। এই নির্বাচনে কোনো ভোটকক্ষেই ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) থাকছে না। এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সাত্তারের বিরোধী প্রার্থীরা।