একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণকে সমর্থনে যুক্তরাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার সারাহ কুক। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ এখন একটি সিদ্ধান্তমূলক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। ২০৪০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা পাবে। ফলে আজকের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই বর্তমান প্রজন্ম কতটা সফলভাবে দেশকে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে পারবে তা নির্ধারিত হবে।
আজ বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিয়ে সারাহ কুক এ কথাগুলো বলেন। তরুণ বাংলাদেশিদের চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরার লক্ষ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ শীর্ষক গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা জানানোর সময় গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও অন্যদের সাহসিকতার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বয়স ৩৯ বছরের কম জানিয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশ একটি সিদ্ধান্তমূলক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। ২০৪০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা পাবে। ফলে আজ নীতি, কর্মসূচি ও অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে সিদ্ধান্ত নেবে, তার মাধ্যমেই এই প্রজন্ম কতটা সফলভাবে দেশকে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারবে তা নির্ভর করছে।
বাংলাদেশের তরুণেরা উচ্চাভিলাষী, আশাবাদী ও সামর্থ্যবান বলে মন্তব্য করেন সারাহ কুক৷ তিনি বলেন, সমাজে ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতে তাঁরা আগ্রহী। আর তাঁরা মানসম্মত শিক্ষা চান। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে জায়গা করে নিতে তাঁরা জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করতে চান।
সারহ কুক বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জলবায়ুসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরিতে তরুণদের অবশ্যই সামনে থাকতে হবে।
তরুণ জলবায়ু নেতৃত্বকে সমর্থনের উদ্যোগগুলোতে যুক্তরাজ্য সরকার সহযোগিতা করে যাবে বলে জানান হাইকমিশনার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তরুণেরা শাসনপ্রক্রিয়ায় অর্থপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে চান। তাঁরা অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছপ্রক্রিয়া চান। যুক্তরাজ্য সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ও নাগরিক সমাজের কার্যক্রমকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গুরুত্ব দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, শ্রমিকদের বিষয় ও সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। সরকার দেশের তরুণদের আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্রে রেখে কাজ করছে। সরকারের মৌলিক কাজ হবে মানবাধিকার রক্ষা, বৈষম্যহীন আইন ও নীতি কার্যকর এবং রাষ্ট্রে জনস্বার্থভিত্তিক নীতি কার্যকর করা। সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্রিটিশ কাউন্সিল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হেলেন সিলভেস্টার। সমাপনী বক্তব্য দেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টর স্টিফেন ফোর্বস। অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী অংশে ‘স্কিলস ফর দ্য ফিউচার’ শিরোনামে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন এডিবির কর্মসূচি সমন্বয়ক (শিক্ষা) জয়া চৌধুরী, বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সৈয়দ রাশেদ আল জায়েদ, এনএসডিএর পরিচালক (সার্টিফিকেশন) শুভ্রা রায় ও এইচএসসি বাংলাদেশের হেড অব সাস্টেইনেবিলিটি সৈয়দা আফজালুন নেসা। আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কালচারাল অ্যানগেজমেন্টের রিসার্চ অ্যান্ড ইনসাইটস ডিরেক্টর ক্রিস্টিন উইলসন।
গবেষণায় যা পাওয়া গেল
‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি গবেষণা সিরিজ। এই শিরোনামে ২০১০ সালে প্রথম ও ২০১৫ সালে দ্বিতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল। আজ প্রকাশ করা হলো তাদের তৃতীয় প্রতিবেদন।
আজ অনুষ্ঠানে যে গবেষণার ফলাফল ও সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়, তা পরিচালিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩ হাজার ৮১ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন এমঅ্যান্ডসি সাচি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসেসের ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড লার্নিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক আইবেক ইলিয়াসভ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–নির্ভরতা
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ তরুণ অনলাইনে সক্রিয় এবং নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ছেলেদের ৭৭ শতাংশ আর মেয়েদের ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য লক্ষণীয়।
২৭ শতাংশ তরুণের কাছে প্রাথমিক সংবাদ উৎস হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে পারে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জাতীয় রাজনৈতিক যোগাযোগ যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, তাঁদের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি।
লিঙ্গবৈষম্য
জরিপে অংশ নেওয়া ৪৬ শতাংশ তরুণ রাজনৈতিক বিশ্বাস, জব স্ট্যাটাস, আর্থসামাজিক অবস্থান ও অক্ষমতার কারণে বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ২৭ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার কথা জানিয়েছেন। ৩১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশের পারিবারিক সহিংসতার কথা জানা গেছে।
নারী ও তরুণীরা পুরুষের সমান—এমন মনে করেন না ৩০ শতাংশ তরুণ। নারী ও তরুণীদের ঘরের বাইরে পুরুষের মতো একই স্বাধীনতা পাওয়া উচিত—এমনটি মনে করেন না ২৫ শতাংশ তরুণ।
কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহ বেশি
ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রতিবেদন বলছে, তরুণেরা যেসব বিষয়ে অগ্রগতি দেখতে চান, তার মধ্যে শিক্ষা ১ নম্বর। ৪৯ শতাংশ তরুণ পাঠদানের নিম্নমানের কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে তাঁরা আধুনিক কর্মবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাহীন পাঠদান ও পাঠ্যসূচির কথা উল্লেখ করেছেন।
ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষা, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শিক্ষা জরুরি বলে মনে করেন ৬৫ শতাংশ তরুণ। আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য তরুণেরা বিভিন্ন সফট স্কিলের দিকে ছুটছেন। যেমন যোগাযোগ দক্ষতা, ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উপস্থাপনা দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে ইংরেজি ভাষা, ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে। ৭৯ শতাংশ তরুণ ইংরেজি ভাষাদক্ষতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন; কিন্তু ইংরেজিতে দক্ষতা আছে মাত্র ৫ শতাংশের।
বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ
বেকারত্ব ৪২ শতাংশ তরুণের উদ্বেগের বিষয় বলে উঠে এসেছে নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশের প্রতিবেদনে। তরুণদের মতে চাকরির ক্ষেত্রে অন্য বাধাগুলোর মধ্যে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি (৩৭ শতাংশ), নিয়োগে বৈষম্য (২০ শতাংশ) এবং পারিবারিক জীবন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা (১৮ শতাংশ)।
দেশে কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট থাকায় ৫৫ শতাংশ তরুণ আন্তর্জাতিক অভিবাসনের জন্য আগ্রহী। ৪৪ শতাংশ তরুণ বাংলাদেশি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী। চাকরির সীমিত সুযোগের কারণে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। তবে তরুণীদের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ। ৭২ শতাংশ তরুণ ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন; কিন্তু তাঁদের ৬৫ শতাংশ এ ক্ষেত্রে খুবই বিচ্ছিন্ন অনুভব করেছেন।
দেশ কেমন চলছে
২০১৫ সালের ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশে’ ৬০ শতাংশ তরুণ জানিয়েছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন দেশ সঠিক পথেই যাচ্ছে; কিন্তু বর্তমান প্রতিবেদনে তা প্রায় ৯ শতাংশ কমে ৫১-তে নেমে এসেছে।
সুপারিশ
এবারের প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের উন্নয়ন, কারিগরি ও ভকেশনাল শিক্ষা কর্মসূচির সুযোগ বৃদ্ধি, নিয়োগযোগ্যতা ও দক্ষতায় ইংরেজি বিভিন্ন কোর্স আরও ভালোভাবে যুক্ত করা, লিঙ্গ সংবেদনশীল নিয়োগনীতি, স্কুলের পাঠ্যসূচিতে নাগরিক শিক্ষাকে আরও জোরদার করা, স্থানীয় নেতা ও তরুণদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক শিক্ষাকে আরও জোরদার করা, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ তৈরি করা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং সামাজিক বৈষম্য নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া।
সরকারি-বেসরকারি খাত, দেশি-বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, গণমাধ্যম ও তরুণ জনগোষ্ঠীর শতাধিক প্রতিনিধি অংশ নেন এ অনুষ্ঠানে। প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন আইবেক ইলিয়াসভ।