রাজনীতিতে যোগ দেবে বলে শহীদ মনস্থির করল। কিছুদিন কংগ্রেস করে বুঝল এখানে ‘শাইন’ করার সম্ভাবনা নেই। কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দিল শহীদ। লীগের সভা-সমিতিতেও শাইন করতে পারল না। বহু চিন্তার পর সে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হল—নিজস্ব একটি পার্টি করতে হবে, কারণ মন্ত্রী তাকে হতেই হবে।
আবুল মনসুর আহমেদের লেখা ‘ফুড কনফারেন্স’ বইয়ের শহীদের মতো কিছু চরিত্র আজও প্রাসঙ্গিক। দেশের নির্বাচনী ইতিহাস বলছে, বেশ কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হওয়ার আশায় অনেকে নতুন দল গড়ে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় এসব দল ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
নির্বাচনের আগে এসব নতুন রাজনৈতিক দল আলোচনার জন্ম দেয়। তবে এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে এসব রাজনৈতিক দলের পরিণতি সুখকর হয়নি। যে উদ্দেশ্যে এসব দল গঠিত হয়, তা-ও পূরণ হয় না। নির্বাচন ঘিরে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু দলের তৎপরতা বেড়ে যায়। তাদের অনেকে নতুন করে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও পায়। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাতে এবং বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে এ ধরনের রাজনৈতিক দল গঠিত হয় বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে।
নেসার আমিন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ফলাফল’ বইয়ে দেশের প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা, প্রার্থী ও ফলাফল উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, নির্বাচনের আগে আলোচনায় আসা নতুন রাজনৈতিক দল খুব বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পারে না। ভোটের মাঠে তাদের ফলাফলও খুব বেশি আশাব্যঞ্জক হয় না। একসময় আলোচনায় থাকা এমন রাজনৈতিক দল এখন মাঠের রাজনীতিতেও অনুপস্থিত।
বিরোধী দল হয়েছিল ‘কপ’
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের অধীনে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের এই নির্বাচনের প্রতি কোনো সমর্থন ছিল না। তাই তারা নির্বাচন বয়কট ও প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে অন্তরীণ করা হয়।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৯টি দল অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রধান বিরোধীদলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। স্বৈরশাসক এরশাদ যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে সাজানো একটি সমন্বিত প্রতিদ্বন্দ্বী জোট (কপ) তৈরি করা হয়।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৯টি দল অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। স্বৈরশাসক এরশাদ যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে সাজানো একটি সমন্বিত প্রতিদ্বন্দ্বী জোট (কপ) তৈরি করা হয়।
রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে নিয়ে রীতিমতো কৌতুক করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান বিরোধীরা নির্বাচন বয়কট করে। দেখা গেল, মাঠে জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কেউ নেই। এ অবস্থায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের জন্য সাইনবোর্ড ও প্যাডসর্বস্ব কিছু “পায়ে দল”, “হোন্ডা দল”কে বিরোধী দল আখ্যা দিয়ে আসন ছেড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনে নামতে রাজি করানো হয়।’
নির্বাচনে এই জোট পায় ১৯টি আসন। সেই বিরোধী দল ‘কপ’ সরকার অনুগত হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর সেই কপ ভেঙে যায়।
নিবন্ধনই বাতিল হয়েছে পিডিপির
এক-এগারোর সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনীতিতে আলোচিত ছিলেন বিএনপির সাবেক নেতা প্রয়াত ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী। গঠন করেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি)। ২০০৮ সালের ১৩ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন থেকে ২৬ নম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পায় পিডিপি। দলটির প্রতীক ‘বাঘ’।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির প্রার্থী ছিলেন ২১ জন। তাঁদের মধ্যে কেউই নির্বাচনে জিততে পারেননি। দলটির প্রার্থীরা মোট ভোট পান ১৪ হাজার ২২৮টি। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা। তবে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ জন প্রার্থী দিয়েছিল দলটি। তবে কোনো নির্বাচনেই তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে পিডিপির নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে ইসির ওয়েবসাইট থেকেও দলটির নাম, প্রতীকসহ সব ধরনের তথ্য মুছে ফেলা হয়। বর্তমানে ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকায় পিডিপির ২৬ নম্বর ঘরটি ফাঁকা রয়েছে।
এবার আলোচনায় নেই বিএনএফ
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংসদে বাতিল হওয়ার পর আন্দোলনে নামে বিএনপি। বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজমুল হুদা এবং বিএনপির একসময়ের নেতা আবুল কালাম আজাদের উদ্যোগে গঠিত হয় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)। একপর্যায়ে নাজমুল হুদাকে বহিষ্কার করে দলটির প্রধান হন আবুল কালাম আজাদ।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধীদলীয় জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। নির্বাচনের মাত্র দেড় মাস আগে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর নিবন্ধন পায় বিএনএফ। দলটির নির্বাচনী প্রতীক ‘টেলিভিশন’। বিএনপিবিহীন ভোটে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসে দলটি। বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ ঢাকা-১৭ (গুলশান-বনানী) আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঢেউ তোলে।
এসব দলের নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকে না। কিছু সংসদ সদস্য পদ হয়তো তাঁরা পান, কিন্তু ভিত্তিহীন এসব দলের ভবিষ্যৎ ভালো হয় না। এসব দল করার মধ্য দিয়ে জাতির সঙ্গে একধরনের মশকরা করা হয়।বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
তবে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনএফের সামগ্রিক ফলাফল ভালো ছিল না। দলটি ২২টি আসনে প্রার্থী দেয়। এই প্রার্থীরা ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনেও সাকল্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৯০ ভোট পায়। এর মধ্যে আবুল কালাম আজাদ ঢাকা-১৭ আসনে একাই পান ৪৩ হাজার ৫৮৫ ভোট।
বিএনএফ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৭টি আসনে প্রার্থী দিলেও দলটির কোনো প্রার্থী জিততে পারেননি। দলটির হয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৫৫ জন প্রার্থী মনোনয়পত্র দাখিল করেছেন। তবে এবার নতুন নিবন্ধিত একাধিক রাজনৈতিক দল সামনে আসায় বিএনএফের নাম সরকারি মহলে আলোচনায় নেই।
তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইসির নিবন্ধন পায় তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)। বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা শুরু থেকেই বলে আসছেন, এই দলগুলোর মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে সরকার। এ দল দুটিতে যোগ দেওয়ানোর জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে যাঁদের লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া হয়, তাঁদের অনেকেই অতীতে সংসদ সদস্য ছিলেন।
তবে দুই দলের নেতারা নানা কথা বলে আলোচনার জন্ম দিলেও শেষ পর্যন্ত সাড়া ফেলার মতো কিছু ঘটাতে পারেনি। ইসির হিসাব অনুযায়ী, বিএনএমের প্রার্থী ছিলেন ৫৪টি আসনে। আর তৃণমূল বিএনপির হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন ১৩৫টি আসনে। যেসব প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, সেখানে কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য থাকলেও পরিচিত মুখ খুবই কম।
যদিও তৃণমূল বিএনপি ২৯০টি আসনে এবং বিএনএম ৮২টি আসনে দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছিল। দল দুটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মনোনয়ন পাওয়ার পর এলাকায় যেতে দেরি হওয়া, কাগজপত্র গোছাতে না পারার মতো বেশ কিছু কারণে দলের মনোনীত প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে নিজেদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি।
এই দলগুলোর সমালোচনা করছেন বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। গত ২২ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির বলেন, সরকার তথাকথিত কিংস পার্টি, ভুঁইফোড় পার্টি, ড্রিংকস পার্টি, ছিন্নমূল পার্টি তৈরি করে তাদের দিয়ে তামাশার নির্বাচন মঞ্চস্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দল থেকে নেতা কিনতে গরুর হাটের মতো দরদাম চলছে।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হবে তৃণমূল বিএনপি-ভোটের আগে দলটির চেয়ারপারসন ও মহাসচিব একাধিকবার এমন কথা বলেছিলেন। সংসদ প্রধান বিরোধী দল হওয়ার আশার কথা শুনিয়েছিলেন বিএনএমের নেতারাও। তবে ভোটের মাঠে দল দুটির কোনো প্রার্থীই লড়াই করতে পারেননি।
তবে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের নেতারা বলেছেন, কারও ইন্ধনে তারা দল করেননি। বিএনএম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, কারও পৃষ্ঠপোষকতা, কারও আনুকূল্য, কারও প্রভাবে তাঁরা দল গড়েননি। বিএনপি ভাঙাও উদ্দেশ্য নয়। তিনি বিএনএমকে ‘কিংস পার্টি’ নামে অভিহিত না করারও অনুরোধ করেন।
আগের নির্বাচনগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তৈরি করে নতুন দুই দল তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম। তবে মূল ধারার রাজনীতিকদের দলে ভেড়াতে না পারায় এবং অধিকাংশ আসনে প্রার্থী দিতে না পারায় শুরুতেই তারা কিছুটা হোঁচট খায়।
‘এসব দলের ভবিষ্যৎ ভালো হয় না’
এসব দলের বিষয়ে কথা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, কারসাজির মাধ্যমে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সরকার নতুন দল করে। বিরোধী দল থেকে লোক ভাগিয়ে এসব দলে আনার চেষ্টা করা হয়। এবার প্রধান বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন, মামলা দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হয়েছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে ও ভোটার বাড়াতে নতুন দল গঠন করা হয়েছে।
‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয় বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এসব দলের নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকে না। কিছু সংসদ সদস্য পদ হয়তো তারা পায়, কিন্তু ভিত্তিহীন এসব দলের ভবিষ্যৎ ভালো হয় না। এসব দল করার মধ্য দিয়ে জাতির সঙ্গে একধরনের মশকরা করা হয়।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হবে তৃণমূল বিএনপি—ভোটের আগে দলটির চেয়ারপারসন ও মহাসচিব একাধিকবার এমন কথা বলেছিলেন। সংসদ প্রধান বিরোধী দল হওয়ার আশার কথা শুনিয়েছিলেন বিএনএমের নেতারাও। তবে ভোটের মাঠে দল দুটির কোনো প্রার্থীই লড়াই করতে পারেননি। বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলে দেখা যাচ্ছে, কোনো আসনে জয় না পাওয়া দল দুটির প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বরং আলোচনায় থাকা দলটির শীর্ষ নেতারাও বড় ব্যবধানে ধরাশায়ী হয়েছেন।