আমরা বিএনপি থেকে লোক খুঁজছি না

বিএনপির সাবেক দুজন নেতা সমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েই দলটির শীর্ষ পদে এসেছেন। এ ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। সমশের মবিন চৌধুরী তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন এবং তৈমুর আলম দলটির মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁদের দল নতুন ‘কিংস পার্টি’ কি না, এমন আলোচনা চলছে। এখন হঠাৎ করেই আলোচনায় আসা সমশের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাদির কল্লোল

সমশের মবিন চৌধুরী
প্রশ্ন

আপনি এবং বিএনপির আরেকজন সাবেক নেতা তৈমুর আলম খন্দকার, আপনারা দুজন যোগ দিয়েই তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে এসেছেন। এটি আসলে কিংস পার্টি কি না? কারণ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল যেহেতু বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থানে থেকে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে সরকার কিছু কিংস পার্টি গঠন করছে, এমন আলোচনা রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কোনো একটি পক্ষ কি আপনাদের তৃণমূল বিএনপির মাধ্যমে মাঠে নামিয়েছে?

সমশের মবিন: দেখেন, বাংলাদেশে সর্বশেষ কিংস পার্টি হয়েছিল ড. ইউনূসের অধীনে ‘জনতা শক্তি’ নামের একটি দল। তার পরে কিংস পার্টি হওয়ার সুযোগ আর বাংলাদেশে হয়নি। আমরা মোটেও কিংস পার্টি নই। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বা ভুল একটি ধারণা যে কারও ছত্রচ্ছায়ায় বা কারও সাহায্য নিয়ে আমরা দল করেছি। আমরা সম্পূর্ণ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। নাজমুল হুদা সাহেব যখন তৃণমূল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই তা করেছেন। সে কারণে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন সাংগঠনিক, আর্থিক ও জনবল—এসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো আমরা নিজেরা এগিয়ে নিয়ে যাব। আমরা কোনো কিংস পার্টি নই। আমরা জনগণের পার্টি। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি দল এবং আদর্শের ভিত্তিতে আমরা এগোব।

প্রশ্ন

কিন্তু ২০১৫ সালের অক্টোবরে আপনি বিএনপি ছাড়ার সময় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তাহলে এখন আবার রাজনীতিতে এবং তৃণমূল বিএনপিতে কেন গেলেন?

সমশের মবিন: বিএনপি থেকে ২০০৮ সালে আমার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। তারপর নানা কারণে আমি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করলাম। তখন পদত্যাগপত্রে আমি পরিষ্কার করে একটা কথা লিখেছিলাম, যেহেতু আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেম আমার রক্তে রয়েছে। আমি যদি সুস্থ থাকি, দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার সুযোগ পাই, আমি মানুষের কল্যাণে কাজ করব। আমি মাঝে বিকল্পধারার রাজনীতিতে জড়িয়েছিলাম। ওই দলে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমি মূলত অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কারণ, তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এ ছাড়া বিএনপি প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল এবং সেই দলই তাঁকে লাঞ্ছিত করেছিল। বিকল্পধারায় সমাজ ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে নতুনত্বের কথা বলা হয়েছিল। সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমি বিকল্পধারায় গিয়েছিলাম; কিন্তু তারা সে লক্ষ্যে যেতে পারল না। ফলে আমি বিকল্পধারা থেকে বেরিয়ে এলাম।

প্রশ্ন

বিকল্পধারা থেকে বেরিয়ে আপনি তো দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন।

সমশের মবিন: আমি মাঠের রাজনীতিতে সেভাবে ছিলাম না; তবে রাজনীতিতে নজর ছিল। আর প্রয়াত নাজমুল হুদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। তিনি আগের দলে (বিএনপিতে) বহুবার লাঞ্ছিত হয়েছেন, অবহেলিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। এখন যে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, এর প্রথম রূপরেখা কিন্তু নাজমুল হুদা দিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে। তখন তিনি বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। সে সময় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। এ ব্যাপারে প্রস্তাব দেওয়ার কারণে বিএনপি নাজমুল হুদাকে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল, তখন থেকে উনি বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তারপর কয়েক দফা চেষ্টার পর শেষপর্যন্ত তৃণমূল বিএনপি গঠন করলেন নাজমুল হুদা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে এই দল নিবন্ধন পেয়েছে। ওনার মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা তাঁদের সঙ্গে কাজ করার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি দুঃশাসন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার রাজনৈতিক কয়েকটি শর্তে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েছি। এখন আমরা যেহেতু মাঠে নেমেছি, এখন আমাদের প্রথম কাজ সারা দেশে সংগঠন গড়া ও সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়া।

প্রশ্ন

যেহেতু আপনারা আগে বিএনপির রাজনীতিতে ছিলেন, এখন তৃণমূল বিএনপি—একই ধরনের নাম। ভোটারদের মধ্যে কোনো সংশয় সৃষ্টি করা এর উদ্দেশ কি না? আর বিএনপিতেও একটি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সেটি আপনারা কীভাবে দেখেন?

সমশের মবিন:  না, এটা নতুন কিছু নয়। ভারতে কংগ্রেস ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেস নামে দল আছে। এর মানে এই নয় যে ভোটারদের মধে৵ একটি কনফিউশন (সংশয়) সৃষ্টি করা। আমরা নিজের শক্তিতে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব। নিজের শক্তিতে সংসদ নির্বাচনে যতটা আসন পাব, ততটা নিয়ে আমরা কাজটা শুরু করব।

প্রশ্ন

আপনার বক্তব্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন; কিন্তু এখন নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়েই বিরোধ চলছে। বিএনপি সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে; আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। আপনারা তাহলে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

সমশের মবিন: দেখেন, সত্যি কথা বলতে নির্দলীয় সরকারের এই দাবিটা আওয়ামী লীগ ও জামায়াত তুলেছিল বিএনপি সরকারের সময় ১৯৯৩–৯৪ সালে। তখন নাজমুল হুদা সাহেবই এর একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এখন যে বাস্তবতা, এখন তো এটা সংবিধানেই নেই। এখন সংবিধান পরিবর্তন করার সময় নেই, সুযোগও নেই। কারণ, আওয়ামী লীগ বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে আছে। তারা কোনো চাপও অনুভব করছে না। আমি মনে করি, সংবিধানকে এখন সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এখন থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করানো সম্ভব হলে এবং নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতা সাহসের সঙ্গে প্রয়োগ করলে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করা যেতে পারে। তবে এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে।

প্রশ্ন

সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কি সম্ভব?

সমশের মবিন: আমি মনে করি, সম্ভব।

প্রশ্ন

তার মানে আপনারা এখন নির্বাচনের জন্য মাঠে নেমেছেন।

সমশের মবিন: আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমিও নির্বাচন করব। আমরা দুই শ থেকে আড়াই শ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করব।

প্রশ্ন

আপনি কি সিলেট শহরের আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

সমশের মবিন: সেগুলো আমরা পরে দলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।

প্রশ্ন

আপনারা যে নির্বাচনে অংশ নেবেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে আপনাদের কি কোনো আলোচনা হয়েছে।

সমশের মবিন: না, কোনো আলোচনা হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকার যেমন সংলাপ করেছিল, সে রকম সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো সংলাপ করে, অবশ্যই আমরা সেই সংলাপে অংশ নেব। দলের সঙ্গে দলীয়ভাবে সংলাপে বসব। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসার একটি প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি। আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করব। অন্যান্য দল বা জোট যদি আমাদের সঙ্গে বসতে চায়, আমরা আলোচনা করব। যদি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করাসহ আমাদের আদর্শের সঙ্গে মেলে, তাদের সঙ্গেই আমরা বসতে পারি।

প্রশ্ন

কিন্তু বিএনপি অভিযোগ করছে, নামসর্বস্ব কিছু দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এসব দলে কিছু লোককে ভিড়িয়ে একটি পাতানো নির্বাচন করতে চাইছে সরকার। আপনারাও এই প্রক্রিয়ারই অংশ বলে তারা বলছে।

সমশের মবিন: আমি তো বললাম, আমরা সেটির অংশ না। আমরা অনেক আগেই আদালতের মাধ্যমে নিবন্ধন পেয়েছি। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানো দল। আমরা পাতানো নির্বাচন কেন করব? তবে জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। কারণ, জনগণ ২০১৪ এবং ২০১৮–তে ভোট দিতে পারেনি। এবার জনগণ ভোট দিতে চায়। সেই পরিবেশটা সৃষ্টি করতে হবে।

প্রশ্ন

এখন যে পরিবেশ আছে, তাতে কি জনগণ ভোট দিতে পারবে, সেই সুযোগ আছে?

সমশের মবিন: আমি মনে করি, জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো আপনি দেখেন, ভোটারের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এবং অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন যদি দেখেন, সেখানে আওয়ামী লীগের বিরোধী প্রার্থী জিতেছেন।

প্রশ্ন

কিন্তু স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য আছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সে কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে বলে অনেকে বলছেন। আপনি কী বলবেন?

সমশের মবিন: আমি মনে করি, জনগণ এবার ভোট দিতে পারবে। বিশেষ করে নতুন দলগুলো যদি তাদের নিজের শক্তিতে দাঁড়ায়। জনগণও ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে।

প্রশ্ন

এবার নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি আড়াই শ আসনে প্রার্থী দিতে চাইছে; কিন্তু আপনাদের এখন কত জেলায় কমিটি আছে।

সমশের মবিন: আমাদের এখন ১২টি জেলায় কমিটি আছে। নাজমুল হুদা সাহেব একটি মানবাধিকার দলও করেছিলেন। তাঁর লোকজন আছেন সারা দেশে। আমরা এখন সব জেলায় তৃণমূল বিএনপির কমিটি করার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন

আপনিসহ তৃণমূল বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা বিএনপির রাজনীতিতে ছিলেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে তৃণমূল বিএনপিসহ নতুন দলগুলোতে বিএনপি বা সরকারবিরোধী দলগুলো থেকে আরও লোক টানা হতে পারে। এমন আলোচনাও আছে। সে ধরনের কিছু হচ্ছে?

সমশের মবিন: বাজারে আলোচনা আছে; কিন্তু আমরা বিএনপি থেকে লোক খুঁজছি না। আমরা খুঁজছি তরুণসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে এবং যাঁরা নির্বাচন করতে চান। তবে আমাদের নীতি–আদর্শের সঙ্গে মিলতে হবে। জনগণ কিন্তু একটি নতুনত্ব দেখতে চায়।

প্রশ্ন

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সমশের মবিন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।