আইন অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারেন। বাস্তবে না হলেও কাগজে–কলমে প্রার্থীরা তাঁদের ভোটের ব্যয় ২৫ লাখ টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। বাড়তি ব্যয়ের কথা কেউ কখনো স্বীকার করেন না। কিন্তু এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে এবার। নাটোর–১ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবুল কালাম নিজেই বলেছেন, নির্বাচনে তাঁর ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি সর্বোচ্চ ব্যয়সীমার পাঁচ গুণ বেশি টাকা খরচ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রায় সবাই সংসদ নির্বাচনে কোটি টাকার বেশিই খরচ করেন। কিন্তু ভোট শেষে নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁরা ব্যয়ের যে হিসাব দাখিল করেন, সেখানে তা ২৫ লাখ টাকার মধ্যেই রাখেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) যেহেতু প্রার্থীদের ব্যয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখে না, তাই আসল খরচের চিত্রটি কখনো সামনে আসে না। কিন্তু নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করা দুর্নীতির অপরাধ। ইসির উচিত আবুল কালামের বক্তব্য ধরে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া। তবে ইসি বলছে, ফলাফলের গেজেট হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের করণীয় কিছু নেই।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, একজন প্রার্থী তাঁর জন্য দলের পক্ষ থেকে ব্যয় করা টাকাসহ সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনে ব্যয় করতে পারেন। গত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের ভোটারপ্রতি ব্যয় ছিল সর্বোচ্চ ১০ টাকা। কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গেলে তিনি কোন কোন উৎস থেকে কত টাকা খরচ করবেন, তার একটি সম্ভাব্য বিবরণী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। আর ভোট শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে প্রার্থীদের সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ব্যয় বিবরণী জমা দিতে হয়।
অন্য সবার মতো ভোটের আগে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আবুল কালাম নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের জন্য টাকা পাওয়ার সম্ভাব্য উৎসের বিবরণী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, তাঁর সম্ভাব্য খরচের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকা। তাঁর হাতে থাকা নগদ টাকা, ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও পোস্টাল সেভিংসে থাকা টাকা থেকে তিনি এই টাকা খরচ করবেন। ভোট শেষে তিনি যে ব্যয় বিবরণী দাখিল করেছেন, সেখানে কত ব্যয় দেখিয়েছেন তা চেষ্টা করেও জানা যায়নি।
তবে আবুল কালামের নিজের বক্তব্য এই টাকার পরিমাণ ১ কোটি ২৬ লাখ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এইটা আমি তুলব, যেভাবেই হোক। এটুকু অন্যায় আমি করব, আর করব না।’ তাঁর ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
অবশ্য নিজের বক্তব্যের বিষয়ে সংসদ সদস্য আবুল কালাম পরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সিরিয়াস কোনো কথা বলিনি। কথার কথা বলেছি। এটা মজা করেও বলা যেতে পারে। আমি নির্বাচনী খরচের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বোঝাতে চেয়েছি, আগামী দিনে আমি টাকার পাহাড় গড়তে চাই না, আমি শুধু খরচের টাকা তুলতে চাই। এটা অন্যায়ভাবে না কিংবা কারও কাছ থেকে অবৈধভাবে না। আমার সম্মানী থেকে উপার্জন করতে চাই। এই কথাকে বিকৃতভাবে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।’
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী যদি নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত বিবরণীতে উল্লেখ করা উৎস ছাড়া ভিন্ন কোনো উৎস থেকে নির্বাচনী ব্যয় বহন করেন বা সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা ২৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করেন, তাহলে ওই প্রার্থী দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এই অপরাধের সাজা দুই থেকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
অবশ্য নির্বাচন কমিশন বলছে, এখন আবুল কালামের বিরুদ্ধে কিছু করার এখতিয়ার তাদের নেই। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থীরা নির্বাচনের পর একটি ব্যয় বিবরণী দাখিল করেন। তবে এটি নিরীক্ষা করে দেখার মতো জনবল ইসির নেই। এ ছাড়া ফলাফলের গেজেট হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের কিছু করার থাকে না।
সচিব আরও বলেন, কোথায় কে কী বলেছেন, সে বিষয়ে ইসির কিছু করার নেই। নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট হওয়ার আগে যদি কেউ অভিযোগ করতেন যে কোনো প্রার্থী অতিরিক্ত ব্যয় করছেন, তাহলে কমিশন তখন তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারত।
ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, নির্বাচন কমিশন অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান নয়। তবে এখন দুর্নীতি দমন কমিশন বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা এটি খতিয়ে দেখতে পারে কোনো প্রার্থী হলফ করে যে ব্যয় করার কথা জানিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছেন কি না। এর পরিপ্রেক্ষিতে বা আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত হলে নির্বাচন কমিশন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে।
তবে ইসির বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি মনে করেন, এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অপরাধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আছে নির্বাচন কমিশনের। বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের হাত অনেক লম্বা। নির্বাচনী বিরোধের ক্ষেত্রে ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পর তাদের কিছু করার থাকে না। কিন্তু এটি নির্বাচনী বিরোধ নয়। প্রার্থী এখানে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে আছে। তাদের উচিত ওই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তিনি সংক্ষুব্ধ হলে আদালতে যাবেন।