দলীয় নেতারা মনে করছেন, জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি এক দশকের মধ্যে সরকারের সবচেয়ে ‘অজনপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত।
জ্বালানি তেলের দাম ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বাড়িয়ে দেওয়ার পর অস্বস্তিতে পড়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, একলাফে দাম এতটা বাড়িয়ে দেওয়া সরকারের এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ‘অজনপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক ও সমমনা দলগুলোও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট। কোনো কোনো শরিক দলের নেতা এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য বিরোধিতা করছেন। কেউ কেউ বলছেন, দাম রেকর্ড হারে বাড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, দেশে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক চড়া, মানুষ কষ্টে রয়েছে।
সরকার গত শুক্রবার রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করে। আর পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ১৩০ এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মূল্যবৃদ্ধির হার ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ। দাম এমন সময়ে বাড়ানো হয়েছে, যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে। শুধু সৌদি আরব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য দাম কিছুটা বাড়িয়েছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গণবিরোধী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি না ঠেকাতে পারা সরকারের ব্যর্থতা।জি এম কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসানের কথা বলছে। তবে দেখা যাচ্ছে, বিপিসি ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত টানা সাত অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ওই সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কম থাকলেও সরকার দেশে তেমন একটা কমায়নি। এখন বিপিসি কয়েক মাস ধরে লোকসান দিতেই ডিজেল-পেট্রলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
সরকারের এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে কেউই সমর্থন করছেন না। বিশ্লেষকদের মধ্যে যাঁরা বিশ্ববাজার ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে জ্বালানির দাম কিছুটা সমন্বয়ের পক্ষে ছিলেন, তাঁরাও এতটা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সমালোচনা করছেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্যে মূল্যবৃদ্ধিকে যৌক্তিক বলার চেষ্টা করলেও ভেতরে-ভেতরে অস্বস্তি প্রকাশ করছেন। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন স্তরের ছয়জন নেতা, মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য এবং আওয়ামী লীগের তিনজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর তৈরি হওয়া পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলে তাঁদের বেশির ভাগই হতাশা প্রকাশ করেন। তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তুলে ধরার মতো শক্ত যুক্তি নেই। সরকারের সিদ্ধান্তের সপক্ষে বলতে গেলে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। আবার মানুষের কষ্টের কথা বললে সরকার অস্বস্তিতে পড়বে। এ জন্য চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করছেন তাঁরা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কাছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প কিছু ছিল না। তবে দাম একবারে এত বেশি না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ানোর সুযোগ হয়তো ছিল। তিনি বলেন, মানুষের দুঃখ-কষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে কেউ বেশি অনুভব করেন না। তবে এটাও বুঝতে হবে সব সময় এক রকম যায় না। খারাপ সময়ও আসে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশকেই খারাপ পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এখন সবাই মিলে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মূল্যায়ন হলো, সরকার টানা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। এ সময় বিরোধীদের দমন ও নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সামনে এসেছে। কিন্তু অর্থনীতি গতিশীল থাকায় এবং বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়নি। এখন অর্থনীতি চাপে পড়েছে। চলতি হিসাবে ঘাটতি ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, ডলারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। খাদ্যপণ্যসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষকে আরও কষ্টে ফেলা দেওয়া হলো। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের সাফল্য ছাপিয়ে এখন সামনে এসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। সরকারের একটি বড় সাফল্য ছিল বিদ্যুৎ–সংকট দূর করা। এখন দিনে ৩ থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং সেই সাফল্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পরিবহন খাত ও নিত্যপণ্যের বাজারে কতটা পড়বে, তা থেকে মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা হবে, সরকারের তদারকি ব্যবস্থা কী—এসব বিষয়ে সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিনই তা পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা মানেননি, আরও বেশি ভাড়া আদায় করেছেন। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর কোনো তদারকি ব্যবস্থা নেই। দলের নেতাদের অনেকে আবার পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক।
আওয়ামী লীগের নেতা কাজী জাফর উল্লাহও স্বীকার করেন যে সরকারনির্ধারিত হারের চেয়ে বাসে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে যাত্রীদের প্রতিবাদ করতে হবে। সরকারকেও তদারকি জোরদার করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও নিত্যপণ্যের চড়া দাম নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সবাই সরকারের বিরোধী অবস্থানে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারবিরোধী অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। নানা বিষয়ে বিরোধী দলগুলো মাঠে নেমে আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের হাতে উপলক্ষ তুলে দেওয়া হলো।
এই দফায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন বলে দাবি করছে দলীয় সূত্র। নেতারা কেউ কেউ মনে করছেন, সরকারের এ ধরনের অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ আমলারা প্রভাবিত করে থাকতে পারেন। সরকার অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদেরা, এমনকি মন্ত্রিসভার সদস্যরাও গুরুত্ব পাচ্ছেন না। এ কারণেই জ্বালানির মূল্য একলাফে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পেরেছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা দেখাতে সরকার নানা ব্যাখ্যা-বিবৃতি দিয়েছে। তবে এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় সরকারের রাজনৈতিক শরিক ও মিত্ররা।
১৪–দলীয় জোটের শরিক দলগুলো বরাবরই নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবাদমুখর। এবার তারা জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জোরালো বিরোধিতা করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতন্ত্রী পার্টি বেশি সক্রিয়। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরদিন এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার বিষ গিলল।’
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আগামী কয়েক দিনে ১৪–দলীয় জোটের শরিকদের কেউ কেউ বিক্ষোভ-প্রতিবাদ সভার মতো কর্মসূচি নেওয়ার কথা ভাবছে।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু মনে করেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি সব দিক বিবেচনা করে নেওয়া হয়নি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। এর ফলে সরকার যে আয় করবে, তা সাত লাখ কোটি টাকার বাজেটের কাছে নগণ্য। মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকার জন্য দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের পেটে লাথি মারা উচিত নয়। সরকারের কাছে তিনি জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তিনি জানান, এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে তাঁরা মিছিল-মিটিংও করবেন।
আওয়ামী লীগের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টি (জাপা)। তাঁরা সংসদের প্রধান বিরোধী দল হলেও গত এক যুগে মাঠে-ময়দানে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কোনো আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেনি। কখনো কখনো সংসদে সরকারের সমালোচনা করে দলটির সংসদ সদস্যরা বক্তব্য দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের কাছে দলটি ‘সরকারের কাছে’র দল হিসেবেও পরিচিতি।
অবশ্য জাপাও মাঠে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে। দলটির সূত্র জানিয়েছে, গত রোববার দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রথম দিন গতকাল সোমবার ঢাকার কাকরাইলে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। আজ মঙ্গলবার সারা দেশে জাপার বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও সব ইউনিটের উদ্যোগে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ‘গণবিরোধী’ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি রয়েছে।
জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গণবিরোধী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি না ঠেকাতে পারা সরকারের ব্যর্থতা। এর মাধ্যমে সরকার সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলার পথে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মেগা প্রকল্প চাই না। মানুষের খাবার, ভালোভাবে বাঁচার ব্যবস্থা চাই।’