মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুটি পক্ষের একটি সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমানের, অপর পক্ষে আছেন সদ্য সাবেক মেয়র ইকরামুল হক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদর আসনে মূল লড়াই হয়েছিল নৌকা ও স্বতন্ত্র ট্রাক প্রতীকের মধ্যে। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কাউন্সিলর ট্রাকের পক্ষে কাজ করেন। আর নৌকার পক্ষে মাঠে ছিলেন স্বল্পসংখ্যক কাউন্সিলর।
বিগত সংসদ নির্বাচনের দুই মাস পর আগামী ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ভোটারদের মতে, সংসদ নির্বাচনের প্রভাব সিটি নির্বাচনেও রয়ে গেছে। ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুটি পৃথক পক্ষ রয়েছে। কাউন্সিলর প্রার্থীদের যাঁরা নৌকায়, আর যাঁরা ট্রাকের পক্ষে কাজ করেছিলেন, সেটি বিবেচনায় নিয়ে দুই পক্ষ এবারও মাঠে নেমেছে।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান (শান্ত)। নির্বাচনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হকের বড় ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হক। ভোটে আমিনুল হক হেরে যান মোহিতের কাছে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ড। মোহিত উরের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক অনুসারীদের হিসাবে, বিগত সংসদ নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের ২২ জন কাউন্সিলর ট্রাক প্রতীকের পক্ষে কাজ করেন। বাকিদের প্রায় সবাই নৌকার পক্ষে ছিলেন। সংসদ নির্বাচনে যেসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা ট্রাকের পক্ষে কাজ করেছিলেন, আসন্ন সিটি নির্বাচনে সেসব ওয়ার্ডে নিজেদের প্রার্থী দিয়েছেন মোহিতের সমর্থকেরা৷ অন্যদিকে যেসব কাউন্সিলর নৌকার পক্ষে ছিলেন, তাঁদের বিপরীতে ট্রাকের হয়ে কাজ করা নেতারা এবার সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন৷
ময়মনসিংহ সদর আসনের সংসদ সদস্য মোহিতের রাজনৈতিক সহযোগীদের অন্যতম মহানগর যুবলীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক রাসেল পাঠান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা শেখ হাসিনার নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন, আমরা তাঁদের জেতাতে চাই। বর্তমান কাউন্সিলর ও নতুন প্রার্থী মিলিয়ে অন্তত ২০টি ওয়ার্ডে নিজেদের লোকদের কাউন্সিলর নির্বাচিত করতে চেষ্টা চলছে।’
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন পাঁচজন। এর মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক (টেবিল ঘড়ি প্রতীক) ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক) ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান (হাতি প্রতীক) প্রার্থী হয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারী নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে কোনো মেয়র প্রার্থীর পক্ষে নামেননি। তবে নিজেদের পছন্দের কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন।
কাউন্সিলর পদে বিভক্তির লড়াই
আসন্ন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ফরহাদ আলম। সাধারণ কাউন্সিলর পদে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১৪৯ জন। অধিকাংশ ওয়ার্ডেই প্রার্থীর সংখ্যা ৪ থেকে ৬ জন। সর্বোচ্চ ৮ জন প্রার্থী রয়েছেন তিনটি ওয়ার্ডে।
৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর আসিফ হোসেন। তিনি গত মেয়াদে সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়রও ছিলেন। আসিফ মেয়র প্রার্থী ইকরামুল হকের আত্মীয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ট্রাক প্রতীকের পক্ষে কাজ করেছিলেন।
আসিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিভেদ হয়েছে, সেটা সত্য। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাররা প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা দেখেই ভোট দেয়। এখানে দলীয় বিভেদ খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।
৭ নম্বর ওয়ার্ডে মোহিতের সমর্থকেরা কাজ করছেন আরেক কাউন্সিলর প্রার্থী সঞ্জীব সরকারের পক্ষে। সঞ্জীব সরকার মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছি। এই ওয়ার্ডে যাঁরা নৌকার হয়ে কাজ করেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ আমার পক্ষে আছেন।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীর প্রচারকে ঘিরে কয়েকটি ওয়ার্ডে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। বেশ কিছু ছোটখাটো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছিল সে সময়। দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও রাজনৈতিক–সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, মহানগর আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে দুই ভাগে বিভক্ত। সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রাখে ইকরামুল এবং মোহিতের সমর্থকদের বিভক্তি আরও প্রকাশ্যে এলো।
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর আব্বাস আলী। তিনি জাতীয় নির্বাচনে ট্রাক প্রতীকের পক্ষে কাজ করেছিলেন। এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মোহিতের অনুসারী। জাতীয় নির্বাচনে তিনি নৌকার পক্ষে কাজ করেছিলেন।
একইভাবে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর মোস্তফা কামাল ট্রাকের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তাঁর বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন নৌকার পক্ষে কাজ করা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এ এস এম কামরুল হাসান।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কাজী আজাদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই এমন বিভক্তি দেখা গেছে। হয়তো সিটি নির্বাচনের পর দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সবাইকে ডেকে বিভক্তি ভুলিয়ে দেবেন।’