আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পাঁচটির মধ্যে তিনটিতে মেয়র পদে নতুন প্রার্থী বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই নতুন প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বার্তা হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। কেউ কেউ মনে করছেন এবার শ খানেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের কপাল পুড়তে পারে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি ভাবনা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে—আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো হবে না। এই নির্বাচনে বিপুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের। এই পরিস্থিতিতে বিতর্কিত ও নিজ নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান দুর্বল, এমন নেতাদের মনোনয়ন দিয়ে ঝুঁকি নেবে না ক্ষমতাসীন দলটি। এ জন্যই দলের অনেক সংসদ সদস্য বাদ পড়তে পারেন। কেউ কেউ বাদ পড়তে পারেন বয়সের কারণে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ৪৯ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বাদ পড়েছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বিতর্কিত। বার্ধক্যের কারণে বাদ পড়েন দু-চারজন। পরেরবার ২০১৮ সালে ৪০ জনের মতো বাদ পড়েন, তবে বাদ পড়াদের মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন শুধু উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। আর আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজে থেকেই অবসরে চলে যান। বাকি যেসব সংসদ সদস্য বাদ পড়েন, তাদের বেশির ভাগই জোটের আসন সমঝোতার বলি হন। কেউ কেউ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বাদ পড়েন। আবার দল ও সরকারকে আলাদা করার চেষ্টার কারণেও কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দলের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে গত এক দশকের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারের জনপ্রিয়তা আছে। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাও জনপ্রিয়। কিন্তু দলের মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও নেতাদের একটা বড় অংশই নিজ নিজ এলাকায় বিতর্কিত। তাঁরা দলের ভেতর অন্তর্কোন্দলে জড়িত। একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন। আর অনেকে নিয়োগ-বদলি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণসহ নানা কাজে বদনাম কুড়িয়েছেন। ফলে পুনরায় তাঁদের মনোনয়ন দিলে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে ভোটের মাঠে ‘ফ্রেশ’ একটা দল নিয়ে নামতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
বিষয়টি গত শনিবার পাঁচ সিটির প্রার্থী বাছাইয়ের মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকেও আলোচনায় এসেছে। বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করছে। মানুষের জীবন–মান উন্নয়নে সব সহায়তা দিচ্ছে। এরপরও অনেক সময় ভোটের মাঠের জরিপ নেতিবাচক আসে। এর মূল কারণ, দলীয় কোন্দল। একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত। এর ফলে জনমনে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে সিটি করপোরেশনের ভোটে দলীয় প্রার্থীর পরিবর্তন ইঙ্গিত বহন করে। ভোটারের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিবেচনা করে সিটিতে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনেও বড় পরিবর্তন আসতে পারে। কারণ, যাঁদের নিয়ে দল জয়ী হতে পারবে বলে মনে করে, তাঁদেরই মনোনয়ন দেওয়া হবে।
২০১৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে মূল চ্যালেঞ্জ ছিল আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা এবং যেকোনোভাবে ভোট সম্পন্ন করা। এ জন্য ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে বিএনপিসহ বিরোধীরা অংশ নেয়। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ‘পুরোনোদের’ রেখে দেওয়ার চিন্তার কারণে খুব বেশি বাদ পড়েননি। ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন ৪০ জনের মতো সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় ছাড়া মন্ত্রিসভার আর কেউ বাদ পড়েননি।
মনোনয়ন তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দলীয় নেতা হত্যার মামলায় কারাগারে থাকা টাঙ্গাইলের বিতর্কিত আমানুর রহমান খানের (রানা) আসনে তাঁর বাবা আতাউর রহমান খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
কক্সবাজারে অবৈধ মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছেন সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহমান বদি। তাঁর নিকট আত্মীয়দের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে মামলাও হয়েছিল। তাঁদের অনেকে সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার সুযোগ নিয়ে আত্মসমর্পণও করেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয় তাঁর স্ত্রী শাহীনা আক্তার চৌধুরীকে।
এর বাইরে সংসদের বিভিন্ন আসনে আলোচিত বাদ পড়া নেতাদের মধ্যে ছিলেন, দলের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও বি এম মোজাম্মেল হক। দল ও সরকারকে আলাদা করার একটা প্রয়াস থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছিল বলে আলোচনা ছিল।
এ ছাড়া বয়সের কারণে বাদ পড়েছিলেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন বাদ পড়েন ওই আসনে নতুন প্রার্থী দেওয়ার কারণে। শওকত আলী ও জাহাঙ্গীর হোসাইন দুজনই প্রয়াত হয়েছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সাবেক মন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান বাদ পড়েন নিজেদের দুর্বল অবস্থানের কারণে। প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেওয়ায় তাঁর ভাই এ কে আবদুল মোমেন মনোনয়ন পান সিলেটে শহরের আসনে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৪৬ জন নতুন মুখ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক সচিব, সাবেক আইজিপি, জাতীয় দলের ক্রিকেটার ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৯ জন সংসদ সদস্য বাদ পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, দুর্নীতি, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, জনবিচ্ছিন্নতা, দলীয় কর্মকাণ্ডে অনীহা ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে এসব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য বাদ পড়েন। এ ছাড়া কয়েকটি আসনে দলীয় কোন্দল থাকায় এসব আসনে অপেক্ষাকৃত নবীন ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার বাদ পড়েছিলেন। এর মধ্যে এ কে খোন্দকার বয়সের কারণে বাদ পড়েন। অন্যরা ‘জনবিচ্ছিন্নতার’ অভিযোগে মনোনয়ন পাননি।
এ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সেবার বাদ দেওয়া হয়। যদিও পরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সেই অভিযোগ কানাডার আদালতে নাকচ হয়।
আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা বরিশালের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, সাদিক আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। এরপরও তাঁকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
ওই নেতারা আরও বলেন, এই ঘটনা থেকে এটা বোঝা যায় যে আগামী নির্বাচন জয়ী হতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত আছেন।
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, জনবিচ্ছিন্ন কাউকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না, এই বার্তা স্পষ্ট। যেনতেনভাবে মনোনয়ন পেয়ে যাবেন, কেউ ভাবলে ভুল করবেন।
দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আস্থা আছে, ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্যরাই মনোনয়ন পাবেন। এ ক্ষেত্রে কে বাদ পড়লেন আর কে থাকলেন, সেটা বিবেচনা করা হবে না।