ঢাকায় গতকাল বিএনপির সমাবেশ এবং সামনের কর্মসূচি ঘিরে নতুন করে গ্রেপ্তার শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদারসহ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২৪৯ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের বেশির ভাগই বিএনপির গতকাল বুধবারের সমাবেশে যোগ দিতে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, নতুন করে তাদের নেতা–কর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আমার চিকিৎসক আমাকে বলেছেন, আমি বাঁচব আর মাত্র চার বছর। এর মধ্যে এক বছর চলে গেছে।বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস
আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্র ও পুলিশ জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির ১৯৮ জন নেতা–কর্মীকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ১১ জনকে দুদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেছেন আদালত। বিএনপি বলছে, নয়াপল্টনের সমাবেশে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেতা-কর্মীরা ঢাকায় আসেন। তাঁদের রাস্তা এবং নগরীর বিভিন্ন হোটেল থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া ঢাকায় নেতা-কর্মীদের বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়েও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর মধ্যে গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদারকে তাঁর গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। একই সময়ে রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকা থেকে জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া কাকরাইলে মেরিনা আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে ৫১ জনকে আটক করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য উপাদানাবলি আইনে এই মামলা করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
বিএনপির গতকালের সমাবেশকে কেন্দ্র করে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন
বিএনপির দাবি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার তাঁর বিরুদ্ধে থাকা সব মামলায় জামিনে আছেন। তাঁতী দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদসহ দুজনকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে করা একটি মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের করার কথা জানিয়েছেন কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুকুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওই মামলা দায়ের হয়েছিল।
এদিকে গত রাতে ডিবি পুলিশ কাকরাইল এলাকার মেরিনা আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে বিএনপির ৫১ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মো. রাজীব আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর কয়েকটি হোটেলে অবস্থান করে কিছু ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার রাতে মেরিনা আবাসিক হোটেলে অভিযান চালানো হয়। সেখানে গেলে তাঁদের ওপর ককটেল ছুড়ে মারা হয়। এতে কেউ আহত হননি। এ সময় ডিবি পুলিশ সেখান থেকে স্থানীয় বিএনপির ৫১ নেতা-কর্মীকে আটক করে।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ৫১ জন নেতা–কর্মীসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে ডিবি পুলিশ মামলা করে। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। গ্রেপ্তার ৫১ জনকে আজ বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হবে বলে থানা-পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
আমার স্বামী রাজনীতি করে না; দোকানদারি করে। অথচ আমার স্বামীকে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।বশিরের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন
গত রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগের কর্মসূচিগুলোতে বিএনপি নেতা–কর্মীরা ভাঙচুর চালানোর সময় তাঁদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন সেই ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়েছিল। সেসব মামলার আসামি হিসেবে এখন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বিএনপির গতকালের সমাবেশকে কেন্দ্র করে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
পুলিশ ও ঢাকার আদালতে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যেসব নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৮৮ জনকে পুরোনো ৪৫টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। এই পুরোনো মামলার বেশির ভাগ দায়ের করা হয়েছে গত বছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর ও চলতি বছরের মে ও জুলাই মাসে। এর বাইরে শুধু বাড্ডা থানার একটি মামলায় বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদারসহ ১২ জন নেতাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ।
গতকাল ঢাকার সিএমএম আদালতে দেখা যায়, বিভিন্ন থানায় গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের দুপুর ১২টার পর থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে আসে পুলিশ। তাঁদের একনজর দেখার জন্য আদালতের সামনে ভিড় করেন স্বজনেরা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত আদালতের সামনে স্বজনদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। বেলা তিনটার পর শুনানি শেষে আবার বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রিজন ভ্যানে করে হাজতখানা থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিএনপির নেতাদের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা জানান, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও এভাবে বিএনপির বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তখন প্রায় প্রতিদিনই আদালতের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের স্বজনদের ভিড় লেগে থাকত।
গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে গতকাল রাত ১০টার দিকে গুলশানের বাসা থেকে বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে বাড্ডা থানায় নতুন করে দায়ের করা একটি নাশকতার মামলায় তাঁকেসহ ১২ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়। এ মামলায় গ্রেপ্তার ভোলা জেলা যুবদলের সভাপতি জামাল উদ্দিনসহ ১১ জনকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়। রিমান্ড শুনানির জন্য তাঁদের প্রত্যেককে আদালতকক্ষে তোলা হয়।
তখন রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের পক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, রুহুল কুদ্দুস ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁকে যেন আদালতকক্ষে তোলা হয়। তখন আদালতের নির্দেশে হাজতখানা থেকে রুহুল কুদ্দুসকে এজলাসে আনা হয়। এ সময় তিনি নিজের শারীরিক অবস্থার কথা আদালতের সামনে তুলে ধরেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘প্রতি মাসে আমাকে কেমোথেরাপি নিতে হয়। এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি কেমোথেরাপি নেন। তবে আমেরিকা থেকে ওষুধ না আসায় ৩ অক্টোবর আমি কেমোথেরাপি দিতে পারিনি। এখন ওষুধ এসেছে।’
রুহুল কুদ্দুস আদালতকে আরও বলেন, ‘আমার চিকিৎসক আমাকে বলেছেন, আমি বাঁচব আর মাত্র চার বছর। এর মধ্যে এক বছর চলে গেছে।’
রুহুল কুদ্দুসের আইনজীবী তাহেরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যানসারে আক্রান্ত রুহুল কুদ্দুস নিজেই তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা আদালতে তুলে ধরেন। আমরা তাঁর জামিন চেয়ে আবেদন করেছিলাম। আদালত সেই আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।’
এ ছাড়া বাকি ১১ জনকে দুদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন আদালত।
ঢাকায় বিএনপির গতকালের সমাবেশকে কেন্দ্র করে গতকাল বুধবার সাভার ও ধামরাইয়ে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশিচৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ অন্তত ৩০ জনকে আটক করেছে। সংশ্লিষ্ট থানা–পুলিশ জানিয়েছে, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
এ ছাড়া গতকাল নারায়ণগঞ্জে তল্লাশিচৌকিতে ঢাকাগামী যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ২০ জনকে আটক করেছে।
গত জুলাই মাসে দায়ের করা কদমতলী থানার একটি মামলায় মাতুয়াইলের বশির আহমেদকে গত মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে গতকাল সিএমএম আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে পুলিশ। অপরদিকে তাঁর জামিন চেয়ে আবেদন করেন তাঁর আইনজীবী। আদালত জামিন না দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। লিখিতভাবে তাঁর পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়, তিনি কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে বশির জড়িত নন। সন্দেহ করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে রাতে গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়ার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান বশিরের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। গতকাল সকাল ১০টার দিকে কলেজপড়ুয়া মেয়ে আর স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে আসেন তাসলিমা খাতুন। বেলা দুইটার পর প্রিজন ভ্যানে করে বশিরকে হাজতখানায় নেওয়া হয়। তখনো বাবার দেখা পায়নি ছেলে ও মেয়ে। পরে সন্ধ্যা ছয়টার সময়ও তিনি হাজতখানায় অবস্থান করছিলেন।
বশিরের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী রাজনীতি করে না; দোকানদারি করে। অথচ আমার স্বামীকে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’
বিএনপি অভিযোগ করেছে, নতুন করে বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করা হয়েছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, নতুন করে গ্রেপ্তারের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস, অস্ত্র ও খুনের মামলায় আগে থেকে যাঁরা জড়িত, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাঁদের গ্রেপ্তার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গতকাল সমাবেশে বলেন, তাঁদের দলের বড় সমাবেশ–কর্মসূচির আগের দিন নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। গতকালের সমাবেশকে কেন্দ্র করেই ২৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তাদের (সরকারের) পরিকল্পনা হচ্ছে বিএনপির যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, তাঁদের সাজা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া। তাহলে তাদের মাঠ পরিষ্কার। মামলা-হামলা করে আর জনগণকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।